রবিবার, ২২ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

সাংবাদিক সায়মন ড্রিংকে লুকিয়ে রাখি তোশকের নিচে

ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ

সাংবাদিক সায়মন ড্রিংকে লুকিয়ে রাখি তোশকের নিচে

প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু প্রায় সমঝোতায় এসে গিয়েছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের সব বিষয় বঙ্গবন্ধু নির্ধারণ করবেন।

ইয়াহিয়া খান ঘোষণাও দিয়েছিলেন পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সমগ্র পাকিস্তান নিয়ে আগ্রহ ছিল কম। তিনি চেয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের অধিকার ও স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সন্ধ্যার দিকে খবর ছড়িয়ে  পড়ল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সমঝোতা ভ-ুল হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা সিদ্ধান্ত নিল পূর্ব পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার। ঢাকার একমাত্র আন্তর্জাতিক হোটেল তখন ইন্টারকন্টিনেন্টাল। সেখানে ৪২ জন বিদেশি সাংবাদিক অবস্থান করছিলেন। আমি ছুটলাম বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করতে। রাত ৯টার দিকে সাংবাদিকদের নিয়ে চলে গেলাম হোটেলের দশম ফ্লোরের একেবারে পশ্চিমের সুইটে। সেখান থেকে ঢাকা শহরের অর্ধেক প্রায় দেখা যায়। বঙ্গবন্ধু কী করছেন, সমঝোতার কী হলো এসব বিষয়ে আমি সাংবাদিকদের ব্রিফ করেছিলাম। তাদের জানালাম, সংলাপ ভেঙে গেছে, এখন পাকিস্তান আর্মি টেকওভার করতে যাচ্ছে। তখনই ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা হয়, ‘কেউ হোটেল থেকে বের হবেন না’। সাংবাদিকরা বুঝে ফেললেন কী হতে যাচ্ছে। সন্ধ্যা ৬টার দিকেই আমি শুনেছিলাম ইয়াহিয়া খান ঢাকা ছেড়েছেন। রাত ৯টার পরপরই সুগন্ধা থেকে রাইফেল তাক করে পাকিস্তানি আর্মি গাড়ি নিয়ে বের হতে শুরু করে। দেখলাম, তেজগাঁওয়ের পুরাতন বিমানবন্দরের রাস্তা দিয়ে আর্মিদের বিরাট একটা কনভয় আসছে। তারা আমাদের হোটেলের সামনে এসে থামল। সাকুরার পাশে ছিল ইংরেজি দৈনিক পিপল পত্রিকার অফিস। পাকিস্তানি সেনারা ট্যাংক থেকে নেমে পিপল অফিস জ্বালিয়ে দিল। পরে তারা ধানমন্ডির দিকে রওনা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে গিয়ে তারা ব্যাপক গুলিবর্ষণ করে। মুহুর্মুহু গুলির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। আমি বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ফোন করি। ফোনটা ধরেন হাজী মোর্শেদ নামে কুষ্টিয়ার এক ব্যক্তি। তাকে বলি, পাকিস্তান আর্মির গাড়িবহর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের দিকে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু যেন নিরাপদে সরে পড়েন। হাজী মোর্শেদ বললেন, ‘না, বঙ্গবন্ধু সরে যাবেন না। আমরা উনাকে বার বার বলেছি। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, আমি কোথাও পালিয়ে যাব না। যা হওয়ার এখানেই হবে। তারা এলে আমি এখান থেকেই মোকাবিলা করব।’ বিকালে আমিও বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা সরে পড়। যে যেখানে থাকো সেখান থেকে প্রস্তুতি নাও। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ কর। আমি এখান থেকেই মোকাবিলা করব।’ সন্ধ্যার পরই বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে সব নেতা-কর্মী চলে যান। রাত ১০টার দিকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে তিনটি কালো মার্সিডিজ গাড়ি এসে থামে। জুলফিকার আলী ভুট্টো গাড়ি থেকে নামলেন। আমরা পশ্চিমের সুইটে ছিলাম, তিনি ছিলেন পূর্বের সুইটে। সব সাংবাদিক গেলেন তার সঙ্গে কথা বলতে। আমিও গিয়েছিলাম। তিনি কারও সঙ্গে কথা বললেন না। রাতে ফের বঙ্গবন্ধুকে টেলিফোন করি। ততক্ষণে টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন। রাত তখন ১২টা হবে। হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে। চারদিকে গোলাবারুদের গন্ধ। সারা ঢাকায় আগুন জ্বলছে। রাত দেড়টার দিকে ইন্টারকন্টিনেন্টালে এয়ারফোর্সের একটা বাস এলো। সব সাংবাদিককে নিচে ডাকল। বলল, তোমাদেরকে ১০ মিনিট সময় দিলাম, প্যাকআপ করো। এখনই হোটেল ছেড়ে চলে যেতে হবে। সবাই নিচে নেমে এলেন, আমি রয়ে গেলাম। দুজন সাংবাদিকও রয়ে গেলেন। একজন সাইমন ড্রিং, অন্যজন অ্যাসোসিয়েট প্রেসের ফটোসাংবাদিক। উনারা যেতে চাননি। আমরা তাদের বিছানার নিচে তোশক-চাদর দিয়ে ঢেকে রাখি। অন্যদের বাসে তোলা হলো। পরে শুনলাম, এয়ারপোর্টে তাদেরকে উলঙ্গ করে কাগজপত্র, ক্যামেরা, জুতা, পোশাক সবকিছু রেখে দেয়। সাইমন ড্রিংকে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে নিয়ে গিয়েছিলাম। অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিনসহ নয়জন প্রফেসরকে হত্যার দৃশ্য তাকে দেখাই। সাইমন ড্রিং দুই দিন পর ব্রিটিশ হাইকমিশন হয়ে লন্ডনে ফেরেন। তিনিই প্রথম বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞের কথা পৃথিবীর কাছে তুলে ধরেন। পরে বাংলাদেশের বেসরকারি টিভি চ্যানেল ইটিভির প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। ২৭ মার্চ কারফিউ তুলে নেওয়া হলে আমরা কয়েকজন মিলে সিলেট হয়ে ত্রিপুরায় চলে গেলাম। স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাসে আমি অন্তত আড়াইশ বিদেশি সাংবাদিককে ব্রিফ করেছি কলকাতায়। গৌরবময় উত্তেজনাপূর্ণ ওই সংগ্রামী দিনগুলো এখন শুধুই ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধের সময় যে ঐক্য ছিল সেটা এখন স্বপ্নের মতো মনে হয়। লেখক : বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক আইনমন্ত্রী। অনুলেখক : শামীম আহমেদ

 

সর্বশেষ খবর