মঙ্গলবার, ২৪ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

সংকট নেই তবুও বাজার নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকেট

মানিক মুনতাসির

সংকট নেই তবুও বাজার নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকেট

চালের বাজারে গতকাল অভিযান

দেশে এ মুহূর্তে চাল, ডাল, আটা, ময়দা, ভোজ্য তেল, রসুন, পিয়াজ, চিনি, লবণ, শাকসবজি, মাছ-মাংসসহ সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। এ ছাড়া সামনেই বোরো মৌসুম। আর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হবে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ। পাশাপাশি করোনাভাইরাসের কারণে গণপরিবহন চলাচল কিছুটা সীমিত হলেও খাদ্যপণ্য পরিবাহী গাড়ির চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। যে কোনো ধরনের জরুরি পরিস্থিতিতেও খাদ্যপণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে এ ব্যবস্থা চালু থাকবে। ফলে মুষ্টিমেয় কিছু অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করছেন, দামও বাড়িয়ে দিচ্ছেন। শুধু তাই নয়, আসন্ন রমজানকে কেন্দ্র করে ছোলা, খেজুরসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যও আমদানি করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে চাহিদার সিংহভাগ দেশেই মজুদ রয়েছে। পাশাপাশি খেজুর, ছোলা ও মসুর ডাল আমদানির এলসি খোলা হয়েছে। ফলে এ নিয়ে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে জনসাধারণ ও সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের প্রধান খাদ্যগুলো হচ্ছে ভাত, ডাল, মাছ, মাংস, আটা ও শাকসবজি। এগুলো সবই আমাদের অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত। ফলে নিত্যপণ্য নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। এ মুহূর্তে দেশে অন্তত এক বছরের প্রয়োজনীয় খাদ্য মজুদ রয়েছে। আর খাদ্য সরবরাহ চেইনও স্বাভাবিক। ফলে খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি কিংবা সংকটের ব্যাপারে কেউ যেন গুজব সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকে সতর্ক থাকা প্রয়োজন।’ সূত্র জানান, ব্যবসায়ী, আড়তদার ও মিলমালিকদের সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে নিত্যপণ্যের বাজার। পর্যাপ্ত উৎপাদন, আমদানি, মজুদ থাকার পরও এরই মধ্যে চাল, ভোজ্য তেলসহ কয়েকটি নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে। আসছে রমজান মাস ঘিরে ছোলা, মটর ডালসহ আরও কয়েকটি পণ্যের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করছেন বিভিন্ন স্তরের ব্যবসায়ী। চীনের করোনাভাইরাসে ‘আমদানি বন্ধের’ গুজব ও অজুহাত তুলে মশলাজাতীয় পণ্যের দাম বাড়ানোরও অপচেষ্টা আছে। গত মাসের শেষের দিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো বাংলাদেশ পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) এক গোপন প্রতিবেদনে এসব বিষয় উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, রমজানকে কেন্দ্র করে ও বিশ্বব্যাপী চলমান মহামারী করোনার সুযোগ নিয়ে মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা যাতে নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীনভবে না বাড়াতে পারেন, সেজন্য অসৎ ব্যবসায়ীদের নজরদারিতে আনা, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে শাস্তি দেওয়া ও টিসিবির মাধ্যমে ভর্তুকিতে পণ্য বিক্রির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। চালের মজুদ পরিস্থিতি সন্তোষজনক : এসবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমন মৌসুমে কৃষক মোটামুটি ন্যায্য মূল্য পেয়েছে। তবে বর্তমানে কৃষকের হাতে ধানের মজুদ খুবই কম। কিন্তু কৃষকের হাতে চাহিদা অনুযায়ী চাল রয়েছে। আমন মৌসুমে সরকার ধান কিনলেও সরকারি বিক্রিতে নানা জটিলতার কারণে অধিকাংশ ধান খোলাবাজারের মাধ্যমে মিলমালিক ও আড়তদাররা কিনেছেন। এদের কাছে বর্তমানে ধানের পর্যাপ্ত মজুদ আছে। এ কারণে বাজারে চালের মূল্য নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে চলে গেছে। ফলে বেশি মুনাফার সুযোগ পেলেই তারা বাজারকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চালাতে পারেন। পরিসংখ্যান ব্যুরোর কৃষি শাখার হিসাবে, গত বোরো মৌসুমে ধানের উৎপাদন ছিল ১৯৫ দশমিক ৬১ লাখ টন। আমন মৌসুমে উৎপাদিত হয়েছে ১৪০ দশমিক ৫৫ টন এবং আউশ উৎপাদিত হয়েছে ২৭.৭৫ টন। সর্বমোট উৎপাদন ৩৬৩ দশমিক ৯১ লাখ টন। অন্যদিকে মোট বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২৮৩ লাখ টন। অর্থাৎ উদ্বৃত্ত প্রায় ৮০ লাখ টন। অথচ কোনো কারণ ছাড়া হঠাৎ করেই চালের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। এ ছাড়া খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ১৬ মার্চ পর্যন্ত দেশে সরকারি পর্যায়ে মোট খাদ্য মজুদ ছিল ১৭ লাখ ৫১ হাজার টন। এর মধ্যে চাল ১৪ লাখ ২৯ হাজার টন আর গম ৩ লাখ ২২ হাজার টন। গম ও আটার মজুদও পর্যাপ্ত : চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে সরকারি পর্যায়ে গম আমদানি করা হয়েছে ৩ লাখ ৮৩ হাজার টন। আর বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি করা হয়েছে ৪৭ লাখ ৯১ হাজার টন। দেশে উৎপাদিত হয়েছে ১০ থেকে ১১ লাখ টন গম। আর সারা বছর দেশে গমের চাহিদা রয়েছে ৭০ লাখ টনের মতো। এখনো আমদানি পর্যায়ে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে আরও প্রায় ১০ লাখ টন গম। ফলে দেশে গম, আটা কিংবা ময়দার কোনো ঘাটতি নেই। ভোজ্য তেল : বর্তমানে বেসরকারি পর্যায়ের মিলগুলোর কাছে পরিশোধনের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ ক্রুড অয়েল (অপরিশোধিত) আছে। এ ছাড়া বাজারে পরিশোধিত তেলের সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি ও ভোজ্য সব ধরনের তেলের দামও কমতির দিকে। দেশের ভোজ্য তেল ব্যবসায়ীদের কাছে অন্তত ৫ লাখ টন তেল মজুদ রয়েছে। এ ছাড়া আমদানির জন্য এলসি খোলা আছে অন্তত ৪ লাখ টনের। দেশে বছরে ভোজ্য তেলের চাহিদা প্রায় ১৫ লাখ টন। অর্থবছরের হিসাবে বছরের বাকি রয়েছে মাত্র তিন মাস। পিয়াজ : দেশে বছরে পিয়াজের চাহিদা প্রায় ২৪ লাখ টন। আর অভ্যন্তরীণভাবে দেশে গড় উৎপাদন ১৬ লাখ টন। চাহিদার বাকি ৮-১০ লাখ টন আমদানি করতে হয়। বেশির ভাগই ভারত থেকে আমদানি হয়। চীন, মিসর ও মিয়ানমার থেকেও কিছু আমদানি হয়। এ বছরের শুরুতে হঠাৎ করে বাজারে সংকট তৈরি হলে অন্তত ৫ লাখ টন পিয়াজ অতিরিক্ত আমদানি করা হয়েছে। একই সঙ্গে এ বছর অভ্যন্তরীণভাবে পিয়াজের বাম্পার ফল হয়েছে। বর্তমানে দেশে আমদানিকারক ও কৃষকের হাতে অন্তত ১৫ লাখ টন পিয়াজ মজুদ রয়েছে। ফলে পিয়াজের মূল্য বৃদ্ধি কিংবা সরবরাহে ঘাটতি হওয়ার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই বলে মনে করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। চিনি : চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের তথ্যমতে, দেশে বছরে চিনির চাহিদা ১৬ লাখ টন। সে হিসাবে প্রতি মাসে চাহিদা এক থেকে সোয়া লাখ টন। তবে রমজানে চাহিদা দুই থেকে আড়াই লাখ টন হয়। বর্তমানে দেশের চিনিকলগুলোর গোডাউনে মজুদ আছে ৫৬ হাজার টন। চিনি রিফাইনারি অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, এ বছর তারা ১২ লাখ টন চিনি উৎপাদন করবে। ইতিমধ্যে এর বেশির ভাগই আমদানি করা হয়েছে। ছোলা, মটর ও ডালজাতীয় ভোগ্যপণ্য : রমজানে ছোলার চাহিদা প্রায় ৮০ হাজার টন। অন্যান্য মাসে থাকে ১০-১২ হাজার টন। রমজানে মসুর ডালের চাহিদা ৭৫-৮০ হাজার টন। অন্য মাসগুলোয় ৩০ হাজার টনের মতো। চলতি পঞ্জিকা বছরের প্রথম তিন মাসে অন্তত ৩ লাখ টন ছোলা ও মটরজাতীয় ডাল আমদানি করা হয়েছে। এ ছাড়া টিসিবিও ভর্তুকি মূল্যে বিপুল পরিমাণ ডাল সরবরাহ করছে। ফলে এ মুহূর্তে দেশে ডালের কোনো সংকট নেই। এ ছাড়া চাহিদা অনুযায়ী লবণ উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেশের লবণ পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলোর কাছেও প্রয়োজনীয় লবণ মজুদ রয়েছে। আর শাকসবজি, মাছ, মাংস উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে অনন্য রেকর্ড গড়েছে। সব ধরনের শাকসবজি, মাছ, মাংসের চাহিদা পূরণে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। ফলে এসব খাদ্যপণ্যের কোনো ধরনের সংকট হওয়ার আশঙ্কা নেই। এ বিষয়ে সাবেক খাদ্য সচিব আবদুল লতিফ মন্ডল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমার জানামতে খাদ্য মজুদ পরিস্থিতি বেশ সন্তোষজনক। তবে বেসরকারি খাতে সবচেয়ে বেশি খাদ্য মজুদ থাকে। আর এ বাজারটা মূলত নিয়ন্ত্রণ করেন মিলমালিকরা। সে ক্ষেত্রে মিলমালিকরা যাতে কোনো ধরনের প্যানিক তৈরি করতে না পারেন, সে বিষয়ে সরকারের সতর্ক দৃষ্টি রাখা এখন সবচেয়ে জরুরি। আর মাছ-মাংস উৎপাদনে পৃথিবীতে তো আমরা অনন্য রেকর্ড সৃষ্টি করেছি। ফলে খাদ্য সংকট হওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না।’ নিত্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক রাখতে বিশেষ অভিযান চলছে : করোনাভাইরাস আতঙ্ককে পুঁজি করে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। এসব ব্যবসায়ীর লাগাম টানতে ও নিত্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক রাখতে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে বিভিন্ন সংস্থা।

গতকালও এরই অংশ হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ১৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। র‌্যাব সদর দফতরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম জানান, র‌্যাব-১০-এর সহায়তায় পুরান ঢাকার বাবুবাজারে বিভিন্ন চালের আড়তে অভিযান চালানো হয়। এ সময় চালের দাম বেশি রাখায় ১১টি রাইস এজেন্সিকে ১৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এ ছাড়া মেসার্স মায়া ট্রেডার্স নামের চালের আড়ত সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। অভিযানের পর নির্ধারিত দাম রাখা শুরু করেন চাল ব্যবসায়ীরা। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের (ডিএনসিআরপি) সহকারী পরিচালক মো. আবদুল জব্বার মন্ডল জানান, ফেসবুক ও মেসেঞ্জারে অনেক ভোক্তা হ্যান্ড স্যানিটাইজার উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। মতিঝিলের ইত্তেফাক মোড়ে গিয়ে এর সত্যতা পাওয়া যায়। দেখা যায়, ৩০০ টাকা দামের হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকায়। পরে মডার্ন সাইন্টিফিক শপ ও হাটখোলা সায়েন্টিফিক শপকে ৫০ হাজার করে মোট ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

সর্বশেষ খবর