করোনার প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় টানা ১০ দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর গ্রামের বাড়ির পথে ছুটছেন ঢাকাবাসী। সোমবার বিকাল থেকেই ভিড় বেড়েছে রেলস্টেশন, বাস ও লঞ্চ টার্মিনালে। গতকাল নগরীর কমলাপুর রেলস্টেশন, সায়েদাবাদ ও মহাখালী বাস টার্মিনাল এবং সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল এলাকায় গিয়েও এমন চিত্র দেখা গেছে। ছুটি পেয়ে জনসমাগম এড়ানোর বদলে সাধারণ মানুষের গ্রামের বাড়ি যাওয়ায় এখন নিয়ন্ত্রণের তুলনায় উল্টো গ্রামে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এ ভাইরাস থেকে রক্ষার অন্যতম পথ জনসমাগম এড়িয়ে চলা। যে মানুষগুলো বাস, ট্রেন কিংবা লঞ্চে করে ঢাকা ছেড়ে গেলেন, তারা নিজেরা যেমন করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিতে পড়লেন, তার পরিবার ও গ্রামের মানুষগুলোকেও ঝুঁকিতে ফেললেন। তবে অনিশ্চয়তা নিয়ে ঢাকায় থাকার চেয়ে গ্রামে যাওয়াই ভালো মনে করেন ঢাকা ছেড়ে যাওয়া মানুষগুলো। তারা বলেন, ‘ঢাকায় কাজ বন্ধ হয়ে গেছে, এখানে থাকলে না খেয়ে থাকতে হবে, তাই গ্রামে চলে যাচ্ছি।’ এদের সবাই ঝুঁকি জেনেও গ্রামে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন। জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যেসব মানুষ ছুটি পেয়েই গ্রামের দিকে ছুটে গেলেন, তারা গ্রামগুলোকে ঝুঁকিতে ফেললেন। তিনি বলেন, ‘দেশে করোনা আক্রান্ত ৩৯ জন। এখনো অনেকের পরীক্ষা করা হচ্ছে। কার শরীরে করোনারভাইরাস রয়েছে, এটা কেউ বলতে পারছেন না।’ ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘যিনি গ্রামে যাচ্ছেন তিনি হয়তো আক্রান্ত নন। তবে যেভাবে গাদাগাদি করে যাচ্ছেন, তাতে এর মধ্যে যে-কেউ সংক্রমিত হয়ে থাকতে পারেন। একজনের মাধ্যমে কয়েক হাজার ব্যক্তির সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই যারা বাড়ি গেলেন, নিজের পরিবারের পাশাপাশি নিজের এলাকাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করলেন।’ গতকাল দুপুর ১২টায় কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে সরেজমিন দেখা যায়, টিকিট কাউন্টারের সামনে হাজারখানেক মানুষের লাইন। আর ট্রেনে ওঠার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন কয়েক হাজার মানুষ। ভারপ্রাপ্ত স্টেশন ম্যানেজার মো. হামিদুল ইসলাম খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সকাল থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ১১টি আন্তনগর ট্রেন ছেড়ে গেছে। সবগুলোই অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে গেছে। তিনি বলেন, ১০ দিনের ছুটি ঘোষণার পরই মূলত যাত্রীর চাপ বেড়েছে। সোমবার ৩১ হাজার ৯৬০টি টিকিট বিক্রি হয়েছে। স্টেশনমাস্টার মো. রফিকুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা যাত্রীদের হাতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার মাখিয়েই স্টেশনে প্রবেশ করতে দিচ্ছি। মাইকে বারবার ঘোষণা দিচ্ছি একে অপর থেকে অন্তত এক মিটার দূরত্ব বজায় রাখতে। কিন্তু কেউ কথা শুনছেন না। গাদাগাদি করে ট্রেনে উঠছেন।’ দুপুর ২টা ২০ মিনিটে ঢাকা থেকে রাজশাহীর উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনের যাত্রী মো. শরিফুল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মাল ওঠানো-নামানোর কাজ করি। এখন কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। কোনো ইনকামও নেই। তাই বাড়ি চলে যাচ্ছি।’ রাজশাহীগামী আরেক যাত্রী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নাসিরুদ্দিন তুহিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জানি আমার মাধ্যমেও এ ভাইরাস ছড়াতে পারে, এর পরও বাড়ি যাচ্ছি। কারণ ওখানে একটু খোলামেলা পরিবেশে থাকতে পারব।’ ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি গিয়ে নিজের পরিবারকে ক্ষতিগ্রস্ত করছেন কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সেটা তো হতেই পারে। তবে বাড়ির সবাই বারবার যেতে বলছে, তাই যাচ্ছি।’ বেলা দেড়টার দিকে মহাখালী বাস টার্মিনালে গিয়েও যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। কাউন্টারগুলোর সামনে দেখা গেছে লম্বা লাইন। সকাল থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত এ টার্মিনাল থেকে দেশের বিভিন্ন জেলার উদ্দেশে প্রায় ৩০০ বাস ছেড়ে গেছে বলে টার্মিনাল শ্রমিক ইউনিয়ন জানিয়েছে। জানতে চাইলে ঢাকা জেলা বাস-মিনিবাস পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যকরী সদস্য মো. সাইফুল ইসলাম খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সকাল থেকে বিপুলসংখ্যক যাত্রী এসেছেন। কোনো গাড়িই খালি যায়নি।’ মহাখালী থেকে নওগাঁগামী যাত্রী মুদি দোকানি মো. উজ্জ্বল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ঢাকায় মানুষ কমে গেছে। একদম বেচাকেনা নেই। তাই পরিবার নিয়ে বাড়ি চলে যাচ্ছি।’ বাড়িতে গিয়ে গ্রামের মানুষের ঝুঁকি বাড়াচ্ছেন কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমার ভাইরাস-টাইরাস নেই। আল্লাহ ভরসা, হবেও না।’ উল্লেখ্য, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি ছুটি থাকবে। এর মধ্যে ২৯ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি থাকবে। এর আগে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের এবং পরে ২৭ ও ২৮ মার্চের সাপ্তাহিক ছুটিও যোগ হবে। এ ছাড়া ৩ ও ৪ এপ্রিল সাপ্তাহিক ছুটিও এ ছুটির সঙ্গে যোগ হবে। মঙ্গল ও বুধবার অফিস চলার কথা থাকলেও অনেক অফিস লকডাউন করায় সোমবার বিকালেই নগরবাসী গ্রামের দিকে ছুটতে শুরু করেন।