শনিবার, ৪ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

ফেলনা সুতায় বদলে যাওয়া গ্রাম

আব্দুর রহমান টুলু, বগুড়া

ফেলনা সুতায় বদলে যাওয়া গ্রাম

পুরনো আর ফেলনা সুতা থেকে আবারও তৈরি হচ্ছে নতুন কম্বল এবং শীত পোশাক। দামে কম বলে কম্বলের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে সারা দেশে। চাহিদা থাকায় সারা বছর কাজ করে আয় করছে শ্রমিকরা। আর এ কম্বল ও শীত পোশাক তৈরি করে বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার কয়েকটি গ্রামের মানুষের অর্থনৈতিক দিন ঘুরে গেছে। নিজেদের আয়ে সংসার পরিচালনা করে এখন সুদিনের খোঁজ পেয়েছে।

জানা যায়, জেলা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার পশ্চিমে আদমদীঘি উপজেলার শাঁওইল গ্রাম। এ গ্রামের তাঁতি সম্প্রদায়ের মানুষরা স্বাধীনতার পর নিজেদের আয়ের পথ হিসেবে গামছা এবং লুঙ্গি তৈরি করে স্থানীয় হাটবাজারে বিক্রি করত। দিন যত গড়িয়েছে ততটায় বাজারে এর স্থানীয়ভাবে তৈরি গামছা এবং লুঙ্গি চাহিদার সৃষ্টি করে। পরে এ অঞ্চলে শীতকালে গরম কাপড়ের চাহিদা থাকায় পুরনো কাপড় থেকে কম্বল তৈরি করে বিক্রি শুরু করেন তাঁতিরা। কম দাম হওয়ার কারণে কম্বলের চাহিদা ব্যাপক আকারে বেড়ে যায়। নিজেদের চাহিদা আর আয়ের জন্য নিজেরাই কম্বল তৈরির পর বিপণন করে এর চাহিদা সৃষ্টি করে। এখন সারা দেশেই এ কম্বলের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। গার্মেন্টের সুতা, পুরনো সোয়েটার থেকে সুতা বের করে বিভিন্ন ডিজাইনের চাদর ও কম্বল বুনানো হয়। প্রথম দিকে গ্রামের পুরুষরা চাদর, কম্বল বুনন ও বিক্রি শুরু করলেও এখন নারী-পুরুষ মিলেই এ কাজ করে থাকেন। এখন শুধু শাঁওইল গ্রামেই নয়, পার্শ্ববর্তী গ্রামের প্রায় শত শত পরিবার তৈরি করছে শীতকালে ব্যবহারের জন্য বাহারি রকমের চাদর ও কম্বল। বর্তমানে শাঁওইল গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই রয়েছে ছোট-বড় দু-একটি তাঁত মেশিন। আদমদীঘি উপজেলার শাঁওইল গ্রামের প্রবীণ তাঁত কারিগর মোজাহার হোসেন, মকবুল হোসেন, আবদুল হামিদ, ফজলুর রহমান, আফজাল হোসেন, মীর কাশেম আলী, বিশিষ্ট সুতা ব্যবসায়ী ও শাঁওইল বাজার কমিটির সভাপতি মোফাজ্জল হোসেন জানান, সারা দেশে যখন লাখ লাখ তাঁত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তখন বগুড়া অঞ্চলের হাজার হাজার তাঁত শুধু চাদর কম্বল বুননোর জন্য আজও টিকে আছে। এ গ্রামের তৈরি বাহারি ডিজাইনের বিভিন্ন চাদর ও কম্বল দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এমনিক মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছে। শাঁওইলসহ আশপাশ গ্রামের প্রায় ৪০ হাজার মানুষ চাদর ও কম্বল তৈরি করে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা শাঁওইল গ্রাম থেকে প্রতি শীত মৌসুমে প্রায় কোটি টাকার কম্বল ও চাদর ক্রয় করে থাকেন। তাঁত শিল্প কারিগর আলিমুদ্দিন শেখ জানান, শীত আসার আগে থেকেই তারা এ কাজ শুরু করে দেন। শীত মৌসুমের পরেও চলে এ কাজ। বড় মহাজনরা ডিজাইন দিয়ে সারা বছর চুক্তিতে কাজ করে নেয়। আদমদীঘি উপজেলার শাঁওইল গ্রামের গৃহবধূ আয়শা সিদ্দিকা জানান, তিনি একটি তাঁত মেশিন বসিয়ে চাদর বুননের কাজ করেন। পরিবারের সব সদস্য সেখানে কাজ করেন। তিনি সারা দিনে ১৫ থেকে ২০টি চাদর তৈরি করে থাকেন। প্রতিটি চাদর ৩৫ থেকে ৪০ টাকা লাভ দরে বিক্রি করে থাকেন। গ্রামের চাদর তৈরির কারিগর রেজাউল করিম জানান, এখন রং ও সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায় কম্বল তৈরিতে খরচ পড়ছে বেশি। কম্বল চাদরের পাশাপাশি গামছা, সুয়েটার, হাত মোজা, শিশুদের জন্য বিভিন্ন ডিজাইনের শীতের কাপড়ও তৈরি হচ্ছে।

শাঁওইল হাট ও বাজার কমিটির সভাপতি মোফাজ্জল হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক ফারুক হোসেন জানান, শাঁওইল গ্রামসহ আশপাশ গ্রামের প্রায় ৮ হাজার পরিবারের মানুষ কম্বল ও চাদর তৈরি করে ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। এ কাজের সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ। প্রতি রবিবার ও বুধবার ভোর থেকে শুরু বেলা ১০টা পর্যন্ত চলে বেচাকেনা। হাটবার ছাড়াও বেচাকেনা হয়ে থাকে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা এখান থেকে বিভিন্ন জেলায় চাদর ও কম্বল সরবরাহ করার পাশাপাশি সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমারসহ মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে সরবরাহ করে থাকে।

সর্বশেষ খবর