রবিবার, ৫ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

আতঙ্ক ছাপিয়ে কাজ চলছে পদ্মা সেতুর

লাবলু মোল্লা, মুন্সীগঞ্জ

করোনা আতঙ্ক উপেক্ষা করে দ্রুত এগিয়ে চলছে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর কাজ। পরিúূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবং নিরাপত্তা উপকরণ ব্যবহার করে রাতদিন কাজ করে চলেছেন সেতুর ইঞ্জিনিয়ার ও শ্রমিকরা। পদ্মা সেতুতে কর্মরতরা তাদের সুরক্ষার জন্য মাস্ক, হেলমেট, সেইফটি ভেস্ট, ইয়ার প্লাগ, হ্যান্ড গ্লাভস, স্টিল টো জুতা, গামবুট ইত্যাদি ব্যবহার করছেন। কাজ শেষে নিজেদের প্রয়োজনীয় সুরক্ষাসামগ্রী দিয়ে আবৃত করে বাসস্থানে ফিরছেন। নির্মাণসংশ্লিষ্টরা প্রকল্প এলাকাতেই থাকছেন। সরেজমিন প্রকল্প এলাকা ঘুরে পদ্মা সেতুর বিরতিহীন নির্মাণকাজের এ দৃশ্য দেখা গেছে। দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে পদ্মা সেতু এখন দ্রুত বাস্তবায়নের পথে। সেতুর ৪ কিলোমিটারের বেশি এখন দৃশ্যমান বাস্তবতায়। ইতিমধ্যে ৪২টি পিলারের সবকটির কাজ শেষ হয়েছে। এসব পিলারে বসবে ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে ৪১টি স্প্যান যার ২৭টি স্প্যান পিলারে উঠে গেছে। ১২টি স্প্যান মাওয়ার কুমারভোগ কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে প্রস্তুত রয়েছে। বাকি দুটি স্প্যান ২৭ মার্চ চীন থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশে পাঠানো হয়েছে। এ সেতু দিয়ে ২০২১ সালের শেষ দিকে একসঙ্গে চালু হবে রেল ও সড়ক পরিবহন। এমন লক্ষ্য নিয়ে শত শত শ্রমিক আর প্রকৌশলীর অক্লান্ত পরিশ্রমে এগিয়ে যাচ্ছে মূল সেতুর নির্মাণকাজ। মূল সেতুর ৮৭ শতাংশ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। কংক্রিট আর স্টিলের নিখুঁত গাঁথুনিতে তৈরি হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম এই নান্দনিক সেতুটি। এরই মধ্যে একদিকে শেষ হয়েছে অ্যাপ্রোচ সড়কের নির্মাণকাজ, উভয় পাড়ে দেশের প্রথম প্রবেশ-নিয়ন্ত্রিত এক্সপ্রেসওয়ের কাজ, টোল প্লাজা। পুরোদমে নদীশাসনের কাজসহ দ্রুত এগিয়ে চলছে সেতুর নিচতলায় রেলপথের কাজ। সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত এ সেতুতে সর্বমোট ৬৬টি পিলার বসানো হয়েছে। মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরার মধ্যে নির্মিত মূল সেতুর দৈর্ঘ্য (পানির অংশের) ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। ডাঙার অংশ অর্থাৎ সংযোগ সেতু ধরলে সেতুটি প্রায় ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ। খুঁটির ওপর ইস্পাতের যে স্প্যান বসানো হয়েছে এর ভিতর দিয়ে চলবে ট্রেন। আর ওপর দিয়ে চলবে যানবাহন। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান আবদুল কাদের বলেন, ‘গত ৩১ মার্চ সম্পূর্ণ শেষ হলো পদ্মা সেতুর পিলার বসানোর কাজ। একজন প্রকৌশলী হিসেবে দেশের সর্ববৃহৎ প্রকল্পের ৪২টি পিলারের সব কটির কাজ শেষ করতে পেরে আমি গর্বিত। বর্তমানে করোনা আতঙ্কের মাঝেও আমাদের অভিজ্ঞ টিম স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ করছে।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমানে বহুল আলোচিত শব্দ হলো পারসোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই)। প্রকৌশলী হিসেবে কর্মক্ষেত্রে আমারও পিপিই পরতে হয়। আমাদের পিপিই হলো ইঞ্জিনিয়ারিং পিপিই। যেমন মাস্ক, হেলমেট সেইফটি ভেস্ট, ইয়ার প্লাগ, হ্যান্ড গ্লাভস, স্টিল টো জুতা, গামবুট ইত্যাদি।’ তিনি বলেন, ‘সেইফটি ভেস্ট পরা থাকলে রাতদিন নিজেকে নিরাপদ রাখা যায়। এখানে সবাই স্বাস্থ্যসচেতন থেকে আমরা কাজ করছি।’ সামাজিক সচেতনতা ও সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়ে মুন্সীগঞ্জের পুলিশ সুপার আবদুল মোমেন বলেন, ‘পদ্মা সেতুর নির্মাণ ঘিরে এলাকাটি নিরাপত্তার চাদরে ঘেরা রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতির ওপর এখানে কর্মরতদের স্বাস্থ্য বিষয়ে সব মেসেজ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।’ পদ্মা সেতুর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজের বাংলাদেশ কান্ট্রিপ্রধান মি. রেম জানান, পদ্মা সেতুর মূল কাজে যারা রয়েছেন তারা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষাবিধি মেনেই কাজ করছেন। এখানে চায়না ও বাংলাদেশি শ্রমিক ও কর্মকর্তারা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন। পদ্মা সেতু প্রকল্পসূত্র জানান, পদ্মা সেতু নির্মাণ হলে দেশের প্রবৃদ্ধির হার বাড়বে। পাল্টে যাবে ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার যোগাযোগব্যবস্থা। উন্মোচন হবে নতুন দিগন্ত। দক্ষিণাঞ্চলে গড়ে উঠবে নতুন নতুন শিল্পকারখানা। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বাংলাদেশ প্রতিদিনকে মুঠোফোনে বলেন, দেশবাসীর বহুল প্রত্যাশিত পদ্মা সেতু এখন ৪ কিলোমিটারের বেশি দৃশ্যমান। কাজের গতি দেখে জনমনে আশার আলো দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে সব পিলারের কাজ শেষ হয়েছে। এখন একে একে সব কটি স্প্যান পিলারে বসবে যা শুধু সময়ের অপেক্ষায়। এটা চালু হলে আঞ্চলিক বাণিজ্য সম্প্রসারণে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। বিনিয়োগকারী ও পর্যটকদের জন্য দৃষ্টিনন্দন হবে পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকা। এ প্রকল্পের কারণে স্থানীয় উন্নয়নের পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। এ অঞ্চলকে ঘিরে আলাদা একটি শহর গঠিত হবে। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণসহ এ অঞ্চলে আরও ব্যাপক উন্নয়নের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। আওয়ামী লীগ সরকার ছাড়া অন্য সব সরকারের আমলেই দক্ষিণবঙ্গ অবহেলিত ছিল। এ সেতু বাস্তবায়ন হলে অবহেলিত থাকবে না এ অঞ্চল ও অঞ্চলের মানুষ। ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের সঙ্গে সড়ক নেটওয়ার্ক তৈরি হবে দক্ষিণবঙ্গের। দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গঠনেও পদ্মা সেতু ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৯৯ কমপোজিট ব্রিগেড সেতু কাজের তদারকি করছে। অত্যন্ত দক্ষতায় ও দ্রুতগতিতে শেষ হয়েছে চার লেন সড়কের কাজ। চলছে রেললাইন প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ। স্প্যানের ওপর পাত বসানো, স্প্যানের মাঝে রেললাইনের কাজও চলছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী বছরের শেষ দিকে চালু হবে স্বপ্নের পদ্মা সেতু।

সর্বশেষ খবর