বুধবার, ৮ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

চুলা জ্বলছে না বিহারি ক্যাম্পে

‘হামলোগোকা নাম পাঁচ ঠো বার লেকে গেয়া, মাগার একভি দানা নেহি পায়্যা...একভি দানা নেহি পায়্যা’

সাঈদুর রহমান রিমন

চুলা জ্বলছে না বিহারি ক্যাম্পে

রাজধানীর বিহারি ক্যাম্পে থাকতে হয় গাদাগাদি করে -বাংলাদেশ প্রতিদিন

রাজধানীর মিরপুর ও মোহাম্মদপুর এলাকায় ‘জেনেভা ক্যাম্প’ হিসেবে পরিচিত বিহারি কলোনিগুলোতে প্রায় আড়াই লাখ বাসিন্দা খাবারের অভাবে অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। করোনাভাইরাসজনিত কারণে তাদের দোকানপাট, ক্ষুদ্র কারখানা সব বন্ধ, রুদ্ধ হয়েছে অন্য সব আয়ের পথও। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি খাদ্য-ত্রাণ সহায়তার কিছুই তাদের ভাগ্যে জুটছে না। ডিএনসিসির সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলররা বিহারি ক্যাম্পগুলোর বাসিন্দাদের নামে প্রায় প্রতিদিনই খাদ্য সহায়তার বড় বড় তালিকা তৈরি করছেন, দিনভর কাউন্সিলর কার্যালয়ে তা প্যাকেটজাতও করা হচ্ছে-কিন্তু রাতে সেসব খাদ্য-ত্রাণ চলে যাচ্ছে অজ্ঞাত স্থানে। নিম্ন আয়ের ক্যাম্প অধিবাসী বিহারি পরিবারগুলো ধার-দেনা করে গত শুক্রবার পর্যন্ত রান্নাবান্না করতে পারলেও শনিবার থেকেই অধিকাংশ ঘরে চুলা জ্বলছে না।

রাজধানীর মোহাম্মদপুর কলেজ গেট এলাকায় এবং মিরপুরের কালশীসহ আশপাশের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে ঘন-ঘিঞ্জি পরিবেশে এসব বিহারি ক্যাম্প অবস্থিত। সেসব স্থানে গাদাগাদি, ঠাসাঠাসি অবস্থায় চলে লাখো মানুষের মানবেতর জীবনযাপন। চারদিকেই কাদাপানির স্যাঁতসেঁতে নোংরা পরিবেশ, উৎকট দুর্গন্ধের ছড়াছড়ি। বাতাসে ওড়াউড়ি করে ময়লা-আবর্জনা, ধূলাবালি। আবাসিক এলাকার জন্য ক্ষতিকর কলকারখানা, ক্ষুদ্র শিল্প, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই গলাগলি সহাবস্থান বিহারিদের। মিরপুরের ক্যাম্পসমূহে এক লাখ বিশ হাজারেরও বেশি মানুষ এবং মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে প্রায় সোয়া লাখ মানুষের বাসবাস। রাজধানীর গার্মেন্ট, হোটেল রেস্তোরাঁ, টার্মিনাল, বাসা-বাড়িতে কায়িক পরিশ্রমের কাজ করেই বেশিরভাগ লোকের জীবিকা নির্বাহ হয়। করোনাভাইরাস বিস্তারের শুরুতেই অঘোষিত লকডাউনের শিকার হন দুই ক্যাম্পেরই বাসিন্দারা। নোংরা আবর্জনাময় বিশ্রী পরিবেশে গাদাগাদি করে বসবাসকারী ক্যাম্পগুলোকে করোনা বিস্তারের ঝুঁকিপূর্ণ স্থান হিসেবে চিহ্নিত করে গত ৮ মার্চ থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ক্যাম্প বাসিন্দাদের বাইরে যাতায়াত পুরোপুরি বন্ধ করে দেন। ক্যাম্পগুলোর সীমানায় অনেক বাসিন্দার গড়ে তোলা খুদে কারখানা, দোকানপাট, ওয়ার্কশপসহ নানা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানেও তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। ফলে আয় উপার্জনের সব পথ বন্ধ অবস্থায় আড়াই লাখ নারী-পুরুষ ৮ মার্চ থেকেই ঘরবন্দী হয়ে পড়েন। মিরপুর এলাকায় ডিএনসিসির ৩ নম্বর ওয়ার্ডভুক্ত ফুটবল ক্যাম্পের বাসিন্দা দিল আফরোজা (৩৫), কানন-উদ-দায়মা (২৪) ও রেহেনা খানম (২৮) জানান, তারা গৃহকর্মী হিসেবে একেকজন দুই বেলায় ৬টি বাসা-বাড়িতে কাজ করতেন। মাসিক উপার্জনে ৬/৭ জনের পরিবারের জীবিকা নির্বাহ করেও কমবেশি সঞ্চয় করতেও পারতেন তারা। কিন্তু মাত্র তিন সপ্তাহের বন্দীদশায় তাদের সব জমানো টাকা শেষ হয়ে গেছে। ২/৩ দিন চাল-ডাল ধার-দেনা করেও খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু রেহেনা খানম ও কানন-উদ-দায়মার পরিবারে গত শুক্রবার রাতে আটা গুলিয়ে তা গরম করে খাওয়ার মধ্য দিয়েই রান্নাঘরের চুলা নিভে গেছে। রান্না করার মতো কোনো কিছু সংগ্রহ করতে না পারায় খাবারও যায়নি তাদের পেটে। কিন্তু উভয়ের পরিবারে তিনজন করে শিশু থাকায় তাদের জন্য পাউরুটি জোগাড় করে খাওয়ানো হলেও বাকি সদস্যরা তিন দিনে দুই বার আধাপেট খাবার খেতে পান। বাইরের পরিচিত এক ব্যক্তির বাড়ি থেকে রান্না করে আনা খাবার রীতিমতো জেলখানার কয়েদি স্টাইলে গ্রহণ করে তা খেতে হয়েছে রেহেনা খানম ও তার অসুস্থ স্বামী ইকবালকে। তারা দুজন সোমবার বিকাল ৩টার দিকে ভাত খেতে পেলেও গতকাল বিকাল ৪টায়ও জানেন না কোনো পরিচিত কেউ খাবার দেবে কি না। ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ওয়াপদা বিল্ডিং ক্যাম্প, থাটিনাস ক্যাম্প, মুসলিম ক্যাম্প, শহীদ মিল্লাত ক্যাম্প, জেল্লা ক্যাম্প, এমসিসি ক্যাম্পেও খাবারের অপেক্ষায় বাসিন্দারা। অর্ধাহারে অনাহারের মুখে এটা-ওটা খেয়ে এসব ক্যাম্পের অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মুসলিম ক্যাম্পের সাহাদাত, খলিল খান, জেল্লা ক্যাম্পের আয়মনা বেগম, খুরশিদ বেওয়া, এমসিসি ক্যাম্পের আনোয়ার তার স্ত্রী রশিদা এবং তাদের দুই সন্তান কয়েকদিন ধরে পেটের পীড়ায় ভুগছে। তাদের একটা ট্যাবলেট দেওয়ারও কেউ নেই। ক্ষুব্ধ ক্যাম্প বাসিন্দারা অভিযোগ করে বলেন, ক্যাম্প এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলররা প্রায় প্রতিদিনই হাজার হাজার বিহারি পরিবারে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দিচ্ছেন বলে প্রচার করে বেড়ান। কিন্তু বিহারি ক্যাম্পে ত্রাণের বস্তা কিংবা তৈরি খাবারের প্যাকেট আজ পর্যন্ত দিতে আসেননি কেউ। ডিএনসিসির ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কাজী জহিরুল ইসলাম মানিক জানান, তার ওয়ার্ড এলাকায় প্রায় সাড়ে তিন হাজার বিহারি পরিবারের বসবাস। আগেও কয়েক দফা খাদ্য সহায়তা তিনি নিজে পৌঁছে দিয়েছেন। কবে কোন ক্যাম্পের বাসিন্দাদের খাদ্য সহায়তা দিয়েছেন এমন প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে তিনি বারবার বলতে থাকেন, ‘আজ (গতকাল) রাতে সেখানে বিতরণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে এক হাজার প্যাকেট খাদ্যসামগ্রী। এ জন্য কয়েকটি চ্যানেলের সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। খাবার প্যাকেটজাত করার ছবি তোলার জন্য তিনি এ প্রতিবেদককেও বারবার অনুরোধ জানান। কিন্তু প্রতিবেদক ত্রাণ বিতরণস্থলে সরেজমিন যেতে চাইলে কাউন্সিলর মানিক বলেন- ‘বিতরণ তো করব গভীর রাতে একাকী, গোপনে।’ গত রাত ৮টার সময় এ প্রতিবেদন লেখার সময় কাউন্সিলর জহিরুল ইসলাম মানিক মোবাইল ফোনে এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘দয়া করে লিখবেন যে আমরা গত বিশ দিনেও সরকারের তরফ থেকে একমুঠো চালও ত্রাণ হিসেবে পাইনি। যা করেছি নিজ উদ্যোগে করেছি।’ ক্ষুব্ধ ত্রাণপ্রার্থীরা বলেছেন, সব ক্যাম্পেই গভীর রাতে একাকী ত্রাণ বিতরণের কথা বারবার শুধু ঘোষণাই দেওয়া হয়- কিন্তু ২, ৩ ও ৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলররা কেউ গত বিশ দিনেও একটা দানা পানি, বিস্কুট নিয়ে আসারও সময় পাননি।

ডিএনসিসির ২ নম্বর ওয়ার্ডভুক্ত কুর্মিটোলা ক্যাম্পজুড়ে অনাহারী মানুষের আহাজারি। ওই ক্যাম্পের আশপাশে কেউ গেলেই ভিতরের ঘরগুলো থেকে শত শত নারী-শিশু গলি পেরিয়ে যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সবাই এগিয়ে এসে নিজেদের নাম বলতে থাকে, কেউ কেউ নিজের খুপরি ঘর থেকে আগে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের দেওয়া নাম ও ক্রমিক নম্বরযুক্ত স্লিপ এনে এগিয়ে ধরে, দুমুঠো খাবার চায়। কিন্তু ত্রাণ বিতরণকারী কোনো কর্মকর্তা যাননি শুনে আবারও হতাশ হয়ে মেঝেতেই বসে পড়েন ৭৭ বছর বয়সী আছিয়া বেওয়া। টানা তিন-চার দিনের অনাহারে তার ন্যূব্জদশা। আছিয়া এ প্রতিবেদককে লক্ষ্য করে বলেন, ‘হামলোগোকা নাম ৫ ঠো বার লেকে গেয়া, মাগার একভি দানা নেহি পায়্যা...একভি দানা নেহি পায়্যা।’ বৃহত্তর মিরপুরে ২ নম্বর নতুন ক্যাম্প, বেগুনটিলা ক্যাম্প, শাহ পরান বস্তি, কুর্মিটোলা ক্যাম্প, স্কুল ক্যাম্প, মেডিকেল ক্যাম্প, রাজুর বস্তি, ৩ নম্বর এডিসি ক্যাম্প, ফুটবল ক্যাম্প মিলিয়ে লক্ষাধিক বিহারি জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। ক্যাম্প অভ্যন্তরে আট ফুট বাই ছয় ফুট খুপরি ঘরের মাঝেই গাদাগাদি করে বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে তাদের বসবাস। প্রতিটি পরিবারেই সদস্য সংখ্যা রয়েছে ৫ জন থেকে ৮ জন পর্যন্ত। করোনার কোনো প্রভাব নিয়ে তাদের মাঝে বিন্দুমাত্র উদ্বেগের ছাপ নেই, সবার পেটেই ক্ষুধার যন্ত্রণা। ক্ষোভে দুঃখে ষাটোর্ধ্ব বয়সের গুলফেশা বানু বলে উঠেন : “করোনাভাইরাস জো হ্যায়-এ্যা বড়া আদমি কা বিমার হ্যায়, হামতো এ্যাছি করোনা জিন্দেগি জিইয়ে রাহে হ্যায়।” ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সাজ্জাদ হোসেন জানান, সরকারি দলের কাউন্সিলররাই এ পর্যন্ত কিছু পায়নি-আমি তো বিএনপি দলীয় কাউন্সিলর। আমার কাছে কিছু আসেনি, কিছু আসবেও না। মোহাম্মদপুরের কলেজ গেট সংলগ্ন ক্যাম্পে এক একটি ঝুপড়ি ঘরে দশ-পনেরো জন বসবাস করেন। সরেজমিন দেখা যায়, একটি কামরার ভিতরে রান্না, খাওয়া ও ঘুম। সেখানেই ঠাসাঠাসি করে রাখা প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র। প্রায় সব ঘরেই একই চিত্র। বাসিন্দারা জানালেন, এই ক্যাম্পে সোয়া লাখ থেকে দেড় লাখ লোকের বাস। এতই গাদাগাদি, ঠাসাঠাসি করে বসবাস ওদের, সেখানে করোনা বিষয়ক আলাদা সাবধানতা অবলম্বনের কোনো সুযোগ নেই। মোহাম্মদপুর কলেজ গেট সংলগ্ন বিহারি ক্যাম্পের অধিবাসী হাজী এমরান উল্লাহ রেফায়েত বলেন, ‘আপ লোগ বারবার কি করুনা কি করুনাকা বাত করত্যা হ্যায়-হামারা জিন্দেগিতো খোদ করুনা বান গিয়্যা-ও হাম কাহা যায়্যেগা?’ অপর বাসিন্দা হেলাল উদ্দিন বললেন, ‘আমাদের খাদ্য ত্রাণ সহায়তার নামে বারবার তালিকা করেই যে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের লোকজন গায়েব হয়ে যান-আর খাবারও আসে না, কাউন্সিলর সাহেব ও তার লোকজনদেরও দেখি না।’

সর্বশেষ খবর