বুধবার, ৮ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

চাল নিতে এসে করোনার ঝুঁকি

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

চাল নিতে এসে করোনার ঝুঁকি

মঙ্গলবার দুপুর ১২টা ৫৫ মিনিট। সূর্য মাঝ আকাশে। কড়া রোদে রাস্তায় দাঁড়ানো একটি ট্রাকের দিকে মুখ করে গাদাগাদি প্রায় শ’তিনেক মানুষের দুটি লাইন চলে গেছে ১০০ মিটার দূরে। ভয়াবহ করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সরকার নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধিকে ‘বুড়ো আঙ্গুল’ দেখিয়ে এরা একে অপরকে ঠেলেঠুলে চাল নিয়ে বাড়ি ফিরছে। সেই সঙ্গে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে করোনার ঝুঁকি। এটি রাজধানীর রূপনগর (আবাসিক) এলাকার শিয়ালবাড়ি বস্তির সামনে দাঁড়ানো ওএমএসে ১০ টাকা কেজিতে ট্রাকসেলের একটি চিত্র। গতকাল দুপুরে এই প্রতিবেদকের সামনে একটি লাইনে এক নারী আরেকজনের ওপর মারমুখী হয়ে চিৎকার করছেন। যিনি চিৎকার করছেন, তার অভিযোগ : লাইন না মেনেই ঢুকে গেছে তার সামনে দাঁড়ানো নারীটি। দুজনের মধ্যে বিন্দুমাত্র ফাঁক নেই। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে দেশের মানুষকে রক্ষায় সরকার সারা দেশে অফিস-আদালত, যানবাহন, দোকানপাট বন্ধ রেখেছে (নিত্যপণ্য ও ওষুধের দোকান ছাড়া)। এর ফলে হঠাৎ কর্মহীন হয়ে পড়ে রাজধানীর কয়েক লাখ বস্তিবাসী। নিম্নআয়ের দরিদ্র এসব বস্তিবাসীর জন্য খাদ্য সহায়তা নিশ্চিত করতে গত রবিবার পরীক্ষামূলক শুরু হয়েছে সরকারি উদ্যোগে খোলাবাজারে (ওএমএস) চাল বিক্রি কার্যক্রম। কিন্তু সরকারি এই কার্যক্রমে নেই কোনো সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত লোক, যিনি চাল নিতে আসা লোকদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে ৩ ফুট দূরে দাঁড়াতে বলবেন। মুখে মাস্ক লাগাতে বলবেন।

ট্রাকে বসে চাল মেপে দেওয়া এক তরুণ জানান, বস্তির লোকজন কোনো শৃঙ্খলা মানে না। পুলিশ এসেও চেষ্টা করেছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ৩ ফুট দূরে দূরে দাঁড়িয়ে লাইন ধরাতে। না পেরে শেষে চলে গেছে। শাহীন নামে এ তরুণ ওএমএসের চাল দেওয়ার কাজে ভলান্টিয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার সঙ্গে এ দায়িত্বে রয়েছেন আরও দুজন। চাপাচাপি করে লাইনে দাঁড়ানো এক বৃদ্ধের কাছে জানতে চাওয়া হয়, কেন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে ৩ ফুট দূরে দাঁড়াচ্ছেন না। তার ঝাঁজালো উত্তর : ‘সবাই লাইন না মানলে আমি একলা কী করতাম!’

অর্থাৎ দায় নিতে চাচ্ছেন না কেউ। এ ঠেলছেন ওকে, ও ঠেলছেন তাকে... আর এভাবেই চাপাচাপি, গাদাগাদি করে চলছে ওএমএসের ১০ টাকা কেজির চাল বিক্রি কার্যক্রম। চাল নিতে মানুষের এই চাপাচাপি দেখে পাশ দিয়ে যেতে যেতে এক রিকশাচালকের কণ্ঠে হতাশা ঝরে পড়ে, ‘বেডাইন, অহন সচেতন না অইলে কুনসমো অইবান! চাউল নিতে আইয়া অহন করোনাভাইরাস লইয়া যাইন...!’ 

জানা গেছে, বিশেষ এই ওএমএস কার্যক্রম প্রথমে ঢাকা মহানগরে দুটি কেন্দ্র দিয়ে শুরু হয়েছে। এর একটি হলো ৭ নং ওয়ার্ড, শিয়ালবাড়ী, রূপনগর ঝিলপাড় বস্তি এবং অন্য এলাকা হচ্ছে মহাখালী সাততলা বস্তি। সপ্তাহে তিন দিন (রবি, মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার) সকাল ১০টা থেকে ৩টা পর্যন্ত ওএমএস কার্যক্রম চলছে। ১০ টাকা দরে একজন ভোক্তা জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে সপ্তাহে একবার পাঁচ কেজি চাল কিনতে পারবেন। ঢাকা জেলা প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছে, মহানগরীতে মোট ৭৩টি বস্তি আছে। এই বস্তিগুলোতে ৩৯ হাজার ১৮০টি পরিবার আছে। এখানে মোট জনসংখ্যা প্রায় ২ লাখ। ঢাকা মহানগরে ওএমএস ডিলার কেন্দ্রের সংখ্যা ১২০টি। এই তালিকা থেকে ২৪ জন ডিলার বাছাই করে সপ্তাহে ৩ দিন পর্যায়ক্রমে ৭৩টি বস্তিতে ৩৯ হাজার ১৮০টি পরিবারকে ১০ টাকা কেজি দরে বিশেষ ওএমএস কার্যক্রমের আওতায় ৫ কেজি চাল বিক্রয় করা হচ্ছে।

এ কার্যক্রম ঢাকার জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশনের স্থানীয় কাউন্সিলর, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও খাদ্য মন্ত্রণালয়/খাদ্য অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে ঢাকা রেশনিং ওএমএস ডিলারের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করার কথা। তবে ট্রাকসেলের জায়গায় এসব কর্তৃপক্ষের কোনো প্রতিনিধিকে চোখে পড়েনি। দেখা যায়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাউকে। ভলান্টিয়ার হিসেবে যারা আছেন ছবি তোলার সময় বাধা দিতে তাদের যতটা আগ্রহ দেখা গেছে ততটা আগ্রহ ছিল না ভয়াবহ করোনাভাইরাস থেকে মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে। ফলে ওএমএসের চাল নিতে আসা এসব বস্তিবাসী জীবন বাঁচাতে হাতে করে চাল নিয়ে বাড়ি ফিরছে, নাকি ভয়াবহ মরণ ভাইরাস করোনা নিয়ে যাচ্ছে সেই প্রশ্ন মুখে মুখে ঘুরছে।

সর্বশেষ খবর