মঙ্গলবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা নেই

উৎপাদন ও অভ্যন্তরীণ চাহিদা চাঙ্গা রাখার পরামর্শ খাদ্য নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের

মানিক মুনতাসির

খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা নেই

সরকারের হাতে এখনো ১৫ লাখ টনের বেশি খাদ্য মজুদ রয়েছে। আর সরকারি, মিলমালিক, পাইকার, কৃষক, ভোক্তাসহ বেসরকারি খাত মিলিয়ে দেশে এখনো খাদ্য মজুদ আছে দেড় কোটি টন। দেশের ১৬ কোটি মানুষের হিসাব ধরে প্রতি বছর আড়াই থেকে তিন কোটি টন খাদ্যের চাহিদা রয়েছে। হাওরাঞ্চলে ইতিমধ্যে বোরো ধান কাটা শুরু হয়ে গেছে। সদ্য শুরু হওয়া এই বোরো মৌসুমে যে পরিমাণ ধানের ফলন হয়েছে, তাতে অন্তত ১ কোটি ৬০ লাখ টন চাল উৎপাদিত হবে। একইভাবে গম উৎপাদিত হবে ১৩ লাখ টন এবং ভুট্টা ৪৪ লাখ টন। ফলে খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে অযথা আতঙ্কিত কিংবা শঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সরকার-সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও বিশ্লেষকরা।

দেশে প্রতি মাসে খাদ্যের চাহিদার গড় ১৯ থেকে ২১ লাখ টন, যার প্রায় ৮০ ভাগই অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে মেটানো হয়। খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে প্রতি বছর ৭০ লাখ টন গমের চাহিদা রয়েছে। এবার প্রায় ১৩ লাখ টন গম অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে গম মাড়াইও শুরু হয়েছে। বাকিটা আমদানি করতে হয়। চলতি বছরের গমের চাহিদার প্রায় সিংহভাগ ইতিমধ্যে আমদানি করা হয়েছে। এরই মধ্যে গম আমদানির এলসি নিষ্পত্তি করা হয়েছে ৩৮ লাখ ৪১ হাজার টন এবং চালের এলসি নিষ্পত্তি করা হয়েছে ৬ হাজার টন। সম্প্রতি আরও ৫০ লাখ টন গম আমদানির এলসি খোলা হয়েছে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে, যা শিগগিরই দেশে চলে আসবে বলে আশা করছে খাদ্য অধিদফতর। অন্যদিকে এ বছর ভুট্টা উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় ৪৪ লাখ টন। ভুট্টারও মাড়াইকাজ শুরু হয়েছে।

এর বাইরে খাদ্যপণ্য হিসেবে মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, শাক-সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। দেশে উৎপাদিত খাদ্যপণ্যের সদ্ব্যবহার করতে পারলে আগামী এক বছরে খাদ্য ঘাটতি হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তবে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে বৈশি^ক কৃষি ও সামগ্রিক উৎপাদন খাতে এর প্রভাব পড়বে, যা এ মুুহূর্তে ভাবিয়ে তুলেছে খাদ্য-সংশ্লিষ্টদের। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএও এবং ডব্লিউএফপি বলছে, করোনাভাইরাস পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে বিশ্বে খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। এ জন্য আগাম সতর্কতাও জারি করেছে সংস্থাটি। অন্যদিকে খাদ্যনিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া সচল রাখতে হবে। তাদের মতে, খাদ্যপণ্য যাতে নষ্ট না হয় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য কৃষকদের নানাভাবে প্রণোদনা দিয়ে তাদের উৎপাদন অব্যাহত রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে অনেকটাই এগিয়ে গেছে সরকার। কেননা এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী প্রান্তিক কৃষকদের জন্য ৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি ও ৫ শতাংশ সুদে ৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ, বীজ কেনার জন্য ১৫০ কোটি টাকা এবং কৃষি সরঞ্জাম কেনার জন্য ১০০ কোটি টাকার ঋণের বিভিন্ন প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। এগুলোর কোনো কোনোটির বাস্তবায়নও শুরু হয়ে গেছে।

এ বিষয়ে সাবেক খাদ্য সচিব আবদুল লতিফ মন্ডল বলেন, ‘আমার জানামতে, খাদ্য মজুদ পরিস্থিতি বেশ সন্তোষজনক। তবে বেসরকারি খাতে সবচেয়ে বেশি খাদ্য মজুদ থাকে। আর এ বাজারটা মূলত নিয়ন্ত্রণ করেন মিলমালিকরা, সে ক্ষেত্রে তারা যাতে কোনো ধরনের আতঙ্ক তৈরি করতে না পারেন সে বিষয়ে সরকারের সতর্ক দৃষ্টি রাখা এখন সবচেয়ে জরুরি। এ ছাড়া কৃষক যেন ন্যায্য মূল্য পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। এখনই আমাদের বাজারে চাহিদা কমার কারণে অনেক এলাকায় মাছ, শাক-সবজি ও দুধ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এটি থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে হলে অবশ্যই অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়াতে হবে। অর্থাৎ মানুষের ভোগের মানসিকতা কমানো যাবে না।’ এ বিষয়ে জানতে চাইলে খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) সারোয়ার মাহমুদ বলেন, খাদ্য মজুদ পরিস্থিতি খুবই সন্তোষজনক। আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। সরকার সারা বছরই মৌসুমভেদে খাদ্যশস্য সংগ্রহ করে। সেসব কর্মসূচিও চালু রয়েছে। শুধু সরকারি পর্যায়ে নয়, বেসরকারি পর্যায়ে আরও অনেক বেশি পরিমাণ খাদ্য মজুদ রয়েছে। ইতিমধ্যে সারা দেশে ওএমএস কর্মসূচি চালু হয়েছে। একইভাবে ভর্তুকি মূল্যে ১০ টাকা কেজি দরে চাল সরবরাহ করা হচ্ছে দুর্যোগ মোকাবিলার অংশ হিসেবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানায়, আগামী মাসের শুরুতেই সারা দেশে শুরু হবে বোরো কাটার মৌসুম। এ বছর সারা দেশে বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৪৭ লাখ ৫৪ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ করা হয়েছে। ফলনও খুব ভালো হয়েছে। এ মুহূর্তে প্রধান কাজ হলো এই ফসলটা ঘরে তোলা। এ মৌসুমে সরকারিভাবে ১৮ লাখ টন ধান, চাল, গম সংগ্রহের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন সরকার। আর এ বছর বোরো থেকে অন্তত ২ কোটি টন চাল উৎপাদিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। একইভাবে ভুট্টা ৪৪ লাখ টন, গম ১৩ লাখ টন আসবে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের মাধ্যমে। ইতিমধ্যে এসব ফসলের মাড়াইকাজ শুরু হয়ে গেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মো. আবদুল মুঈদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে হাওরাঞ্চলে ধান কাটার জন্য দেশের অন্য অঞ্চল থেকে শ্রমিকদের নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, জেলা প্রশাসন, জেলার সিভিল সার্জন, উপজেলা প্রশাসন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে সারা দেশে বোরো ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজে শ্রমিক সংকট মোকাবিলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে নেওয়া হয়েছে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ।

খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সরকারিভাবে চাল ও গমের মজুদ রয়েছে ১৫ লাখ ২৭ হাজার ৭৭৮ টন। এ মজুদ গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১ লাখ ৬৬ হাজার টন বেশি। ২০১৯ সালের ৮ এপ্রিল চাল ও গমের মজুদ ছিল ১৩ লাখ ৬১ হাজার ৬৭৩ টন। এর মধ্যে গম ছিল ১ লাখ ৫২ হাজার ৮৪৬ ও চাল ১২ লাখ ৮ হাজার ৮২৭ টন। ৮ এপ্রিল চালের মজুদ ছিল ১২ লাখ ৪২ হাজার ৩৮৩ ও গমের মজুদ ২ লাখ ৮৫ হাজার ৩৯৫ টন। কেননা গত এক মাসে সারা দেশে সরকার ব্যাপক হারে খাদ্য সরবরাহ করছে দরিদ্র শ্রেণির মানুষের জন্য। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটের দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমান মজুদ পরিস্থিতি সন্তোষজনক। এ ছাড়া এ মুহূর্তে খাদ্যশস্যের কোনো ঘাটতি নেই, ঘাটতির আশঙ্কাও নেই। কারণ আমদানি পাইপলাইনে গমের সরবরাহ পর্যাপ্ত রয়েছে। এরই মধ্যে গমের এলসি নিষ্পত্তি করা হয়েছে ৩৮ লাখ ৪১ হাজার টন এবং চালের এলসি নিষ্পত্তি করা হয়েছে ৬ হাজার টন। গমের এলসি খোলা হয়েছে প্রায় ৫০ লাখ টন। এগুলো শিগগিরই দেশে চলে আসবে। এ বিষয়ে খাদ্য সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানামারা খানুম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকারের খাদ্যগুদামে চাল ও গমের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। গত বছরের তুলনায় প্রায় পৌনে দুই লাখ টন খাদ্য মজুদ বেশি রয়েছে। আমদানি করা হচ্ছে পর্যাপ্ত গম। আমদানিকৃত এসব গম স্বল্প সময়ের মধ্যে চলে আসবে। এ ছাড়া ১৫ এপ্রিল থেকে শুরু হচ্ছে সরকারের বোরো মৌসুমে ধান, চাল ও গম সংগ্রহ কার্যক্রম। এবার ১৮ লাখ ২৫ হাজার টন সংগ্রহ করা হবে। গত বোরো মৌসুমের চেয়ে আগামী মৌসুমে দুই লাখ টন ধান বেশি কেনা হবে। ফলে সামনের দিনে মজুদ পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

এ বিষয়ে সাবেক কৃষি সচিব, খাদ্যনিরাপত্তা বিশ্লেষক আনোয়ার ফারুক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আর আমাদের প্রধান খাদ্য ভাত, মাছ, মাংস, শাক-সবজি এর কোনোটাই আমাদের আমদানির প্রয়োজন হয় না। বরং কোনো কোনোটা রপ্তানির মতো সক্ষমতা রাখি। ফলে করোনাভাইরাসের মহামারীতেও আমাদের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন অব্যাহত রাখতে হবে। এ জন্য কৃষকের জন্য ঘোষিত প্রণোদনাগুলোর যথাযথ ব্যবহার করতে হবে। একইভাবে ধরে রাখতে হবে অভ্যন্তরীণ চাহিদা।’ এটি করতে পারলে বিশ্বের অন্যান্য দেশে খাদ্য সংকট হলেও আমাদের দেশে হবে না বলে মনে করেন তিনি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর