করোনাভাইরাস সংক্রমণের এই সময়ে দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিক্রি স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেড়ে গেছে। অন্য সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও সরকারি নিষেধাজ্ঞার বাইরে আছে ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন প্রতিষ্ঠানগুলো। সংক্রমণ আশঙ্কায় হাসপাতালগুলোতে ডাক্তার পাওয়া যাচ্ছে না। বিভিন্ন অসুখে মানুষ পুরনো প্রেসক্রিপশন ধরে ওষুধ কিনছেন। এই সময়ে জনসচেতনতায় ওষুধ কোম্পানিগুলোর কোনো প্রচারণা নেই। অন্য সময়ে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভের (এমআর) মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা শুধু ডাক্তারদের পেছনে ব্যয় করলেও বর্তমানে কোটি কোটি মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় তাদের কোনো ভূমিকা নেই। এই প্রেক্ষাপটে বিশ্ববাজারে প্রসিদ্ধি পাওয়া বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোকে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন প্রচারের মাধ্যমে জনসচেতনতায় ভূমিকা রাখার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ব্যাপারে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরকে বিধিমালা সংশোধন করে ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিজ্ঞাপন প্রচারের সুযোগ করে দেওয়ার কথা বলেছেন তারা।
বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) জানিয়েছে, দেশে ওষুধের বিপণন বাবদ মোট টার্নওভারের ২৯ শতাংশের বেশি খরচ করছে কোম্পানিগুলো। দেশে ওষুধের বাজারের আকার ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। সে হিসাবে শুধু বিপণন বাবদ ওষুধ কোম্পানিগুলো বছরে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ করছে। কিন্তু এই বিপণন প্রক্রিয়াটি খুবই অস্বচ্ছ এবং অগ্রহণযোগ্য। ওষুধ কোম্পানিগুলো প্রধানত ডাক্তারদের উপঢৌকন হিসেবে এই ৬ হাজার কোটি টাকার বেশির ভাগ ব্যয় করে। এজন্য গত তিন-চার দশক ধরে দেশে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ (এমআর) নামে একটি নতুন পেশাজীবী শ্রেণি গড়ে উঠেছে। হাসপাতালের গেটে, ডাক্তারদের চেম্বারের সামনে এসব প্রতিনিধি নিয়মিত জড়ো হন। ডাক্তারদের প্রভাবিত করার মাধ্যমে তারা নিজেদের কোম্পানির ওষুধ লেখান রোগীর প্রেসক্রিপশনে। বিনিময়ে ডাক্তাররা ওষুধ কোম্পানি থেকে পান নানা সুবিধা। প্রকারান্তরে অনেক ডাক্তারই নাকি এখন ওষুধ কোম্পানির বিজ্ঞাপনদাতা। ফলে ওষুধের ক্রেতা জানতে পারছেন না ওষুধের গুণাগুণ ও কার্যকারিতা। ক্রেতা থাকছেন অন্ধকারে। অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের কোম্পানির ওষুধও বিপণন কৌশলে ‘বাজার’ পেয়ে যাচ্ছে। ওষুধ শিল্পের উদ্যোক্তারা জানান, সংবাদমাধ্যমে ওষুধের বিজ্ঞাপন প্রচারে বিধিনিষেধ থাকায় এ কৌশল অবলম্বন করছে তারা। কারণ, কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া প্রচারমাধ্যমে ওষুধের বিজ্ঞাপন প্রচার ১৯৮২ সালের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ অবস্থায় ওষুধের বিজ্ঞাপন বাবদ বিপুল অঙ্কের এ অর্থ খরচ কোথায়, কীভাবে হয় সে প্রশ্ন উঠছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মূলত, ডাক্তারদের তুষ্ট রাখতেই হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে ওষুধ কোম্পানিগুলো। শুধু রাজধানীতে নয়, সারা দেশেই এই প্রক্রিয়াটি অনুসরণ করে ওষুধ কোম্পানিগুলো। এ কারণে মাসের প্রথম সপ্তাহে মফস্বল শহরের অধিকাংশ হোটেল বুক করা থাকে ঢাকার মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের (এমআর) নামে। তারা জেলা শহরের ডাক্তারদের আয়ত্তে রাখতে নিয়মিত চেষ্টা করেন। ডাক্তারদের নগদ আর্থিক সুবিধা ছাড়াও বিদেশ ভ্রমণের ব্যবস্থা, বাসায় নতুন ফ্রিজ, টেলিভিশন, এসির ব্যবস্থা করেন। কোনো কোনো ওষুধ কোম্পানি চিকিৎসকদের ফ্ল্যাট-গাড়ির মতো দামি উপহারও দিয়ে থাকে। তারা ওষুধ বিপণনের প্রয়োজনে ডাক্তারদের এসব দিচ্ছে। এই প্রক্রিয়াটি এখন ওপেন সিক্রেট বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূলত, কোম্পানির নিয়োগকৃত মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভের (এমআর) মাধ্যমে ডাক্তারদের বাসায় উপহার সামগ্রীটি পৌঁছে দেয় ওষুধ কোম্পানি। গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস-এর প্রতিবেদনে ওষুধ মার্কেটিং বাবদ ব্যয় হওয়া এ টাকা কে পায়, সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ নেই। তবে ব্যয়ের খাত সম্পর্কে কিছু ইঙ্গিত রয়েছে প্রতিবেদনে। এমআরের মাধ্যমে চিকিৎসক ও ফার্মেসিতে ওষুধ পৌঁছে দিতে, হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরিতে ও বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে ক্যাম্পেইনে এ অর্থ ব্যয় করছে কোম্পানিগুলো। টেন্ডার ও বিজ্ঞাপনে সামান্য অর্থ ব্যয় হয়।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের অধিকাংশ দেশে ওষুধ বিপণন একটি নিয়মের মধ্যে এলেও দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষ করে ভারত ও বাংলাদেশে তা অনুসরণ করা হচ্ছে না। ওষুধ কোম্পানির টাকায় চিকিৎসকদের বিদেশ ভ্রমণ বা উপঢৌকন নেওয়ার মতো অনৈতিক চর্চাগুলো তদারকির মধ্যে নেই। ফলে বিপণন খরচের বড় অংশ অনৈতিকভাবে ব্যয় হচ্ছে। কিন্তু ওষুধের ভোক্তাশ্রেণি এর মাধ্যমে উপকৃত হতে পারছেন না। এই প্রেক্ষাপটে ওষুধ শিল্পের অরাজকতা বন্ধে ১৯৮২ সালের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ সংশোধন করে সংবাদমাধ্যমে ওষুধের বিজ্ঞাপন প্রচারের ব্যবস্থা করা জরুরি। এর মধ্য দিয়ে ওষুধ শিল্পে একটি সুষ্ঠু বিপণন ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। ওষুধের ক্রেতারা প্রতিটি ওষুধ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাবেন। তারা অসুখ-বিসুখে ওষুধের কার্যকারিতা জেনে-বুঝে কিনতে পারবেন। ফলে ওষুধের বিপণন বাবদ কোম্পানিগুলোকে হাজার হাজার কোটি টাকা অপচয় করতে হবে না।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতিক্রিয়া : গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ওষুধ কোম্পানিগুলো জনগণকে ওষুধের গুণাগুণ তুলে ধরে না। তারা শুধু চিকিৎসকের কাছে এর গুণাগুণ তুলে ধরে। এটা চিকিৎসককে এক ধরনের ঘুষ দেওয়ার মতো। এজন্য ওষুধ কোম্পানিগুলো অনেক অকার্যকর ওষুধও বিক্রি করতে পারে। এতে চিকিৎসক আর কোম্পানিগুলোর লাভ। জনগণের ক্ষতি। এজন্য তারা গণমাধ্যমে ওষুধের গুণাগুণ বা মূল্য তুলে ধরে বিজ্ঞাপনও দিতে চায় না। আমি শুরু থেকেই বলে আসছি, এসব ধান্ধাবাজি বন্ধ হওয়া জরুরি।