বুধবার, ২২ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

হটস্পটগুলোতে কী হচ্ছে

নারায়ণগঞ্জ গাজীপুর নরসিংদী ও কেরানীগঞ্জ

প্রতিদিন ডেস্ক

করোনা সংক্রমণের হটস্পটগুলোতে সরকার ঘোষিত লকডাউন মানছে না কেউ। পাড়া-মহল্লায় এলাকার বখাটে ও কিশোর গ্যাং বাঁশ দিয়ে এলাকা লকডাউন করে রেখেছে যেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী লকডাউনের কড়াকড়ি আরোপ করতে এলাকায় প্রবেশ করতে না পারে। এ পরিস্থিতিতে পুরো এলাকার দোকানপাট খোলা রেখে লকডাউন-ব্রেক ডাউনের খেলা চলছে। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

নারায়ণগঞ্জ : সরকারিভাবে নারায়ণগঞ্জকে লকডাউন করা হয়েছে। কিন্তু আদৌ নারায়ণগঞ্জে লকডাউন চলছে কি না তা নিজ চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে পারবে না। মূলত জেলার মূল শহর বা শহরতলি কোথাও লকডাউনের বালাই নেই। মূল শহরের সবচাইতে ব্যস্ততম দিগুবাবুর বাজার গতকাল ছিল যেন জনসমুদ্র। তাই জেলায় প্রতিদিনই করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। গত সোমবার থেকে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় নতুন করে করোনায় মারা গেছেন ৩ জন ও আক্রান্ত হয়েছেন ১০ জন। গতকাল মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র মতে, জেলায় মোট আক্রান্ত ৪২১ জন এবং মারা গেছে মোট ৩৩ জন। সিটি করপোরেশনের দুই অঞ্চল (বন্দর বাদে) মারা গেছেন ১৭ জন ও আক্রান্ত ৩০৪ জন। অন্যদিকে সিটির বাইরে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেশি সদর উপজেলায়। সেখানে ৮ জন মারা গেছেন ও আক্রান্ত ৬৭ জন। বন্দর উপজেলায় সিটি করপোরেশনের ৯টি ওয়ার্ডে মৃত্যুর সংখ্যা ৫ জন ও আক্রান্তের সংখ্যা ২১ এবং ৫ ইউনিয়নে মৃত্যু ১ ও আক্রান্ত ৫। এ ছাড়া আড়াইহাজারে আক্রান্ত ১২, সোনারগাঁয়ে আক্রান্ত ৬ ও মারা গেছেন ১ জন এবং রূপগঞ্জে মারা গেছেন ১ জন ও ৬ জন আক্রান্ত। মোট মৃত্যু ৩৩ ও আক্রান্ত ৪১১।

কেন এত আক্রান্ত ও মৃত্যু : চারটি নির্দিষ্ট কারণে জেলায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর মিছিল বেড়েছে  বলে জেলায় স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা মতামত দিয়েছেন। প্রথমত লকডাউন না মেনে হটস্পটখ্যাত শহরের কালীবাজার এলাকায় দিগুবাবুর বাজারের গতকালের দৃশ্য দেখলে চোখ কপালে ওঠার মতো। পুরো বাজারজুড়ে ছিল হাজার হাজার মানুষ। বাজার করতে লোকজনের ঢল যেন জনসমুদ্রে রূপ নেয়। বন্দরের কাইক্কারটেকে বসেছে হাট। পাড়া-মহল্লায় এলাকার বখাটে ও কিশোর গ্যাংয়ের কিশোররা নিজেরা বাঁশ দিয়ে এলাকা লকডাউন করে রেখেছে যেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রবেশ করতে না পেরে। সৃষ্ট এ অবস্থায় পুরো এলাকার দোকানপাট খোলা রেখে লকডাউন-ব্রেক ডাউনের খেলা চলছে।

দ্বিতীয়ত. গত ৫ এপ্রিল গার্মেন্ট খোলার ঘোষণা ও লকডাউনের মধ্যে গার্মেন্ট কর্মীদের আন্দোলন। গত ৫ এপ্রিল জেলায় কর্মস্থলে যোগ দিতে প্রায় ৮ লাখ গার্মেন্ট শ্রমিক দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রবেশ করে। এ ছাড়া গত ৭ দিনে অন্তত ১৩টি গার্মেন্টের শ্রমিকরা বকেয়া বেতন, লে-অফ ও শ্রমিক ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদে লকডাউন ভেঙে মূল শহরে আন্দোলন করেন। এতে চরমভাবে বিঘিœত হয় জেলায় লকডাউন ঘোষণা।

তৃতীয়ত. প্রবাসী কোয়ারেন্টাইন ব্যর্থতা : জেলায় সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো বিদেশ থেকে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার প্রবাসী করোনার ভয়ে দেশে ফিরে আসে নারায়ণগঞ্জে। এদের মধ্যে জেলা প্রশাসন সর্বোচ্চ ১১শ জনকে চিহ্নিত করতে পারলেও তাদের কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে পারেনি। এর জ্বলন্ত প্রমাণ দেশে গত ৮ মার্চ সর্বপ্রথম তিনজন করোনা রোগী শনাক্ত হয়। তাদের মধ্যে দুজনই নারায়ণগঞ্জ শহরের জয়নাল প্লাজার বাসিন্দা। এরা দুজন বিদেশ থেকে এসে অন্তত ৫ দিন পুরো জেলাসহ ঢাকায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। পরে তাদের জ্বর, সর্দি ও কাশি দেখা দিলে নারায়ণগঞ্জে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে এরা ধরা পড়ে যে, এরা ইতালি থেকে এসেছিলেন। পরবর্তীতে এদের কুর্মিটোলা পাঠালে করোনা শনাক্ত হয়।

চতুর্থত. অপ্রতুল চিকিৎসা ব্যবস্থা : পয়লা এপ্রিল থেকেই জেলায় করোনা রোগী বাড়তে থাকে। কিন্তু নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন তথা কারোরই এ বিষয়ে বিশেষ কোনো সতর্কতা ছিল না। করোনা উপসর্গ নিয়ে রোগীরা নমুনা সংগ্রহের জন্য আকুতি মিনতি করেও টেস্ট করাতে পারেননি। এ জন্য প্রথম থেকেই করোনা আক্রান্তদের সুস্থদের কাছ থেকে আলাদা করা যায়নি।

নারায়ণগঞ্জে ভুল তথ্যে করোনা প্রতিরোধ চিকিৎসকরা আক্রান্ত : সরকারের পক্ষ  থেকে নারায়ণগঞ্জে প্রথম থেকে দেওয়া হয়নি পিপিই ও মাস্কসহ নানা সরঞ্জাম। এতে অসতর্ক অবস্থায় করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে দিয়ে বর্তমানে জেলায় সিভিল সার্জন ডা. ইমতিয়াজ, উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. জাহিদুল, জেলা বিএমের সভাপতি ডা. শাহনাজ, ঘোষিত করোনা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কসহ অন্তত ২০ জন ডাক্তার, নার্স ওয়ার্ড বয় আক্রান্ত হন। জেলায় ৩০০ শয্যা হাসপাতালকে করোনা হাসপাতাল ঘোষণা করা হলেও সেখানে ছিল না কোনো সরঞ্জাম। এমনকি জেলায় যে একটি করোনা টেস্ট ল্যাব নেই সেটাও প্রধানমন্ত্রী জেনে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন।

এ বিষয়ে করোনা আক্রান্ত থেকে সদ্য সুস্থ হওয়া জেলা সিভিল সার্জন ডা. ইমতিয়াজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে গতকাল সন্ধ্যায় জানান, লকডাউন না মানা, গার্মেন্টকর্মীদের জেলায় ৫ এপ্রিল প্রবেশ, বিদেশ ফেরত দুই ইতালি প্রবাসী যারা প্রথম আক্রান্ত হয়েছিলেন তাদের কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত না করা ও গত  ৩০ মার্চ প্রথম করোনায় মৃত শিউলি পুতুলের লাশ দাফনে অনিয়ম থেকেই জেলায় করোনা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার প্রধান কারণ বলে মনে করছি। তবে এখনো সময় আছে মানুষকে লকডাউন মানাতে হবে।

প্রসঙ্গত এই পর্যন্ত জেলায় মোট ১২০৩ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এই পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত থেকে সুস্থ হয়েছেন ১৬ জন।

সিদ্ধিরগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) : সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন বিভিন্ন এলাকায় অধিকাংশ মানুষকেই ঘুরে বেড়াতে এবং জড়ো হয়ে আড্ডা দিতে দেখা যাচ্ছে। এতে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে নাসিক সিদ্ধিরগঞ্জের প্রতিটি ওয়ার্ডে। এদিকে জনসাধারণকে সচেতন করতে থানা পুলিশ ও র‌্যাবের পাশাপাশি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও স্থানীয় নাসিক কাউন্সিলররাও মাঠে কাজ করে আসছেন। তবে অনেকেই লকডাউন পরিস্থিতি দেখার জন্যও বের হয়েছেন বলে জিজ্ঞাসা করলে জানান। কোথাও কোথাও চায়ের দোকানে যুবকদের জমজমাট আড্ডা দিতেও দেখা গেছে। এদের কারও কারও মুখে মাস্ক থাকে আবার অনেকের মুখে থাকে না। আবার কেউ কেউ নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেও চলাফেরা করছেন না।

নরসিংদী : নরসিংদীতে ৫ চিকিৎসকসহ ১৩৪ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে জেলায় মোট কভিড-১৯ এ আক্রান্তের সংখ্যা ১৩৫ জন। এর মধ্যে পলাশ উপজেলার শামীম নামে একজন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। এ ছাড়া আক্রান্তদের তিন ভাগের একভাগই জেলার স্বাস্থ্যকর্মী। জেলা হাসপাতাল, সদর হাসপাতাল ও সিভিল সার্জন অফিসসহ বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ৪৪ জন স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন। ফলে জেলাজুড়ে এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে। এদিকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে লকডাউন ঘোষণা করা হলেও তা মানছেন না কেউ। অন্যদিকে গত দুই দিন যাবৎ জেলার হাসপাতালসহ বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হলেও সেসব রিপোর্ট পাওয়া যায়নি।

গাজীপুর : গাজীপুরের দুই থানার ৩১ জন পুলিশ সদস্য করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে ২৪ জন গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের গাছা থানায় কর্মরত। বাকি সাতজন গাজীপুর জেলা পুলিশের কালীগঞ্জ থানায় কর্মরত। জানা গেছে, গত ১৩ এপ্রিল গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের গাছা থানার এক এস আইয়ের প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার রিপোর্ট আসে। এরপর তিনি যাদের সংস্পর্শে এসেছিলেন তাদের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠালে গাছা জোনের এসিসহ আরও ৩ জনের করোনা ভাইরাস পজেটিভ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে দুই দফায় থানার আরও ৫০ জনের নমুনা ঢাকায় পাঠানো হয়। সোমবার ওই ২০ পুলিশ সদস্য আক্রান্ত হওয়ার রিপোর্ট আসে। এ নিয়ে ওই জোনের এসিসহ থানার মোট ২৪ পুলিশ সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্তরা সবাই আইসোলেশনে আছেন।

কেরানীগঞ্জ :  ঢাকার কেরানীগঞ্জে নতুন করে আরও ৮ জন করোনা আক্রান্তের খবর দিয়েছে কেরানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। গতকাল নতুন ৮ জনসহ মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৪ জন। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মীর মোবারক হোসেন জানান, কেরানীগঞ্জে প্রতিদিনই বাড়ছে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। এই উপজেলা করোনাভাইরাসের একটি ডেঞ্জার জোন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কেরানীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিয়মিত সাধারণ মানুষকে ঘরে রাখতে ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা চলছে। ৫ এপ্রিল কেরানীগঞ্জে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। দুই সপ্তাহের ব্যবধানেই উপজেলা পর্যায়ে কেরানীগঞ্জ আক্রান্তের তালিকা সর্বোচ্চ হয়ে ওঠে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর