বুধবার, ২২ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধুর খুনিকে নিয়ে কলকাতায় যত ধোঁয়াশা

দীপক দেবনাথ, কলকাতা

এলাকায় কেউ চেনেন ‘সমীর কুমার দত্ত’ কেউ ‘ডাক্তার দত্ত’ কেউবা ‘দত্ত দা’। বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার ঠাকুরনগরে ইউনানী চিকিৎসক এই ‘ডাক্তার দত্ত’-ই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারী রিসালদার মোসলেম উদ্দিন কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট দ্বন্দ্বে পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ ও গোয়েন্দারাও। সম্প্রতি কলকাতার একটি দৈনিকে রিসালদার আটকের বিষয়ে খবর প্রকাশ হলে তা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ভিন্ন তথ্য পেয়েছে পুলিশ ও গণমাধ্যম কর্মীরা। সেই সমীর কুমার দত্তই যদি রিসালদার মোসলেম হয়ে থাকেন, তাহলে গত জানুয়ারি মাসে তিনি মারা গেছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

জানা গেছে, গত রবিবার রাত থেকে দফায় দফায় সমীর কুমার দত্তের খোঁজে গাইঘাটা থানার শিমুলপুরের বাসিন্দা প্রয়াত প্রমোদানন্দ অধিকারীর বাড়িতে যায় গাইঘাটা থানার পুলিশ। এ বাড়িতেই প্রায় ৩৫ বছরের বেশি সময় ধরে থাকতেন এলাকায় পরিচিত ‘ডাক্তার দত্ত’ বা ‘দত্ত দা’। সেখানে কয়েক দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় প্রমোদের ছোট কন্যা মমতা আইচ অধিকারী, তার স্বামী বিশ্বজিৎ আইচ ও স্থানীয়দের। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মর্ডান ইউনানী ফার্মেসির ভিতরের বই, চিঠিসহ বিভিন্ন জিনিস খতিয়ে দেখে পুলিশের কর্মকর্তারা। বাজেয়াপ্ত করা হয় ডাক্তার দত্তের ভারতীয় আধার কার্ড, ভোটার কার্ড। তার শোয়ার ঘরের এক কোনায় টেবিলে সাজানো কিছু বই দেখে চোখ কপালে ওঠার জোগাড় পুলিশ কর্মকর্তাদের। যেখানে সারি দিয়ে সাজানো ছিল চেতন ভগতের লেখা ‘ওয়াট ইয়ং ইন্ডিয়া ওয়ান্টস,’ হুমায়ুন আজাদের লেখা ‘নারী’, বঙ্গভঙ্গ রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশ-এর মতো কিছু বই। তবে এর পাশাপাশি ‘ভারত বিভাজন’, ‘ইরান’, ‘যুক্তিবাদীর চোখে নবী মুহাম্মদ ও কোরআন শরিফ’, ‘ইসলাম কোরান’, ‘হিন্দু মুসলমানের বিরোধ’, ‘দিস ইজ জিহাদ’, ‘গণতন্ত্র ধর্ম ও রাজনীতি’, ‘ইসলামের ভারত অভিযান’-এর মতো কিছু ধর্মীয় গ্রন্থ জিহাদি বই। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় কবিরাজি চিকিৎসা করলেও চিকিৎসাশাস্ত্রের কোনো বই সেই অর্থে ছিলই না। এগুলোও গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখেছে তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তারা। গতকাল সকালের দিকে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, শমুলপুরে পুলিশ ও গণমাধ্যমের কর্মীদের প্রবেশ দেখামাত্রই গ্রামে ভিড় জমে যায়। বঙ্গবন্ধুর খুনি রিসালদারের ছবি গ্রামবাসীকে দেখানোমাত্রই তারা একবাক্যে মেনে নেন তিনিই সমীর দত্ত ওরফে ডাক্তার দত্ত। এরকম একজন ভয়ঙ্কর খুনি তাদের এলাকায় ছিল-এটা ভাবতেই শিউরে উঠেছেন কেউ কেউ। পার্থ প্রতিম ঘোষ নামে এক এলাকাবাসী জানান, ‘তিন মাস আগে শেষবার তাকে এখানে দেখা গিয়েছিল। আমরা আগে জেনেছিলাম উনি হিন্দু, পরে জানতে পারি উনি মুসলিম। তবে হিন্দুদের রীতিনীতি অনুযায়ী সেখানে থাকতেন। কোনো দিন মসজিদে বা ঘরে নামাজ আদায় করতে দেখা যায়নি তাকে।’ প্রায় ২০ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি এখানে থাকতেন এবং গত জানুয়ারি মাসে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বলেও জানান তিনি।

আশ্রয়দাতা প্রয়াত প্রমোদের ছোট কন্যা মমতা আইচ অধিকারী গণমাধ্যমকে বলেছেন, রবিবারের পর সোমবারও রিসালদার মোসলেম উদ্দিনের ভাইরাল হওয়া একটি ছবি দেখানো হয় তাদের। ছবির সেই লোকই তাদের সমীর দত্ত ছিলেন বলে নিশ্চিত করেন তারা। তাকে ডাকতেন ‘দত্ত জেঠু’। তিনি তার বাবার ইউনানী চিকিৎসার ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে চলতি বছরের গত ১০ জানুয়ারি তাদের সেই ‘দত্ত জেঠু’ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

এরপর তাকে গাইঘাটা মহাশ্মশানে নিয়ে দাহ করা হয়। মৃত্যুর সনদও দেখান মমতা।

৩৪ বছর বয়সী মমতা আরও জানান, প্রায় ৩৮-৩৯ বছর আগে দমদমে একটি দোকানে কাজ করার সময় তার বাবা প্রমোদের সঙ্গে পরিচয় হয় সমীর দত্তের। সেই থেকেই তাদের শিমুলপুরের বাড়িতে মাঝেমধ্যে আসা-যাওয়া ছিল তার। বয়সে ছোট প্রমোদকে সমীর দত্ত জানান তার পরিবারের কেউ নেই। তাই প্রমোদের আপত্তি না থাকলে তাদের বাড়িতেই থাকতে চান তিনি। স্বাভাবিকভাবেই মানবিকতার খাতিরে শিমুলপুরের ওই বাড়িতে সমীর দত্তকে নিয়ে আসেন মমতার বাবা প্রয়াত প্রমোদ অধিকারী। প্রথম দিকে তার সহকারী হিসেবেই কাজ করতেন সমীর দত্ত। কিন্তু ২০০৯ সালে বাবার মৃত্যুর পর বাবার ইউনানী চিকিৎসার গোটা বিষয়টি দেখভাল করতেন সমীর কুমার দত্ত এবং শিমুলপুরের প্রমোদের বাড়ির মুখেই বাম দিকে মর্ডান ইউনানী ফার্মেসির একচালা ঘরের পেছনের দিকে তিনি শুতেন, সামনের দিকে প্র্যাকটিস করতেন। তবে ওই বাড়িতে থাকাকালীন কোনো ভাড়া বা খাবার বাবদ কোনো রুপি দিতে হতো না দত্ত দাকে। ছোটবেলা থেকেই তাকে ‘জেঠু’ বলেই ডাকতেন। ফলে বাইরের লোক হলেও ধীরে ধীরে ওই বাড়িরই সদস্য হয়ে ওঠেন তিনি। সমীর দত্তের বর্ণনা দিতে গিয়ে মমতা আইচ বলেন, ‘জেঠু নিজের মুখেই বলেছেন যে, তিনি বাংলাদেশের বাসিন্দা। তার পরিবার, দেশ, শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়ে মমতা একাধিকবার জানতে চাইলে তা সুকৌশলে এড়িয়ে গেছেন। অতটা মিশুকে ছিলেন না। একবেলাই ভাত খেতেন, রাতে মুড়ি বা শুকনো খাবার খেতেন। চা খাবার সময় কেবল আমাদের ঘরে আসতেন। 

মমতা আরও বলেন, তিনি যথেষ্ট শিক্ষিত ছিলেন। মাঝেমধ্যেই ইংরেজিতে কথা বলতেন। চিকিৎসা থেকে আয়ের রুপি দিয়েই চেম্বারে দৈনিক বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে সাত-আট রকমের পত্রিকা রাখতেন। তবে টেলিভিশন দেখতেন না, এমনকি তার নিজস্ব কোনো মোবাইল ফোনও ছিল না। তবে লন্ডনে গিয়ে লেকচার দিয়েছিলেন বলে পারিবারিক আলাপচারিতায় বলেছিলেন সমীর দত্ত। মেধা থাকার পরও কেন চাকরি করেননি, এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার চাকরি জীবন ভালো লাগে না। আমি কোনো একটি জায়গায় স্থির থাকতে চাই না। তবে মাঝেমধ্যেই তিনি উধাও হয়ে যেতেন। এ নিয়ে তার মা প্রশ্ন করলেও তিনি কোনো সদুত্তর দিতেন না।’

সাম্প্রতিককালে কয়েকটি কার্যকলাপে যথেষ্ট সন্দেহ হয় মমতাদের। দুই বছর আগেই ‘শেষ মন্ত্র’ শীর্ষক প্রকাশিত একটি বইয়ের লেখক হিসেবে দিলীপ দত্ত নাম ব্যবহার করা। মমতা জানান, ‘জেঠুর নাম সমীর দত্ত হলেও তা ব্যবহার না করে দিলীপ দত্ত লেখেন।’ তা নিয়ে প্রশ্ন করা হলেও তার কোনো উত্তর দিতে রাজি হননি সমীর দত্ত ওরফে ডাক্তার দত্ত ওরফে দত্ত দা। গ্রামবাসীর একাংশের অভিমত, গত জানুয়ারি মাসে হৃদরোগে মৃত্যুর পর তার দেহ শ্মশানে নিয়ে গেলে কেউ কেউ বলে ওঠেন তিনি মুসলিম, তাই কবর দেওয়া হোক। যদিও সমীর দত্ত নামে ওই ডাক্তার তার আশ্রয়দাতাদের বলেছিলেন তার মৃত্যুর পর যেন তাকে দাহ করা হয়। আর সেই মতোই শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় তার।

সমীর কুমার দত্তই বঙ্গবন্ধুর খুনি রিসালদার কিনা-এ প্রশ্নের উত্তরে গাইঘাটা পঞ্চায়েত সমিতির জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা ধ্যানেশ নারায়ণ গুহ জানান, ‘তিনি মুসলিম হলেও এখানে সমীর দত্ত নাম নিয়ে ভারতের পরিচয়পত্র বের করে ভারতীয় হিসেবে থাকতেন। তার কার্যকলাপে আমরা এক প্রকার নিশ্চিত যে তিনিই বঙ্গবন্ধুর খুনি।’ প্রায় তিন দশক ধরে বঙ্গবন্ধুর একজন খুনি পশ্চিমবঙ্গে গা-ঢাকা দেওয়ার ঘটনা দুর্ভাগ্যজনক ও প্রশাসনিক ব্যর্থতা বলেও আখ্যায়িত করেন এই তৃণমূল কংগ্রেস নেতা।

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর