শুক্রবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

বাজার সয়লাব নিম্নমানের সুরক্ষাসামগ্রীতে

ফুটপাথ-মুদি দোকানেও পাওয়া যায় মানহীন পিপিই, মাস্ক ও গ্লাভস

আরাফাত মুন্না

২১ এপ্রিল বেলা ১১টা। রাজধানীর শনিরআখড়ায় আবদুস সালাম ভ্যানে করে বিক্রি করছিলেন করোনাভাইরাসের সুরক্ষাসামগ্রী। পিপিই উচ্চারণ করতে না পারলেও গলা ফাটিয়ে বলছিলেন, ‘করোনা থেইকা বাঁচেন পিপি নেন, পিপি’। তার ভ্যানে ছিল মাস্ক, গ্লাভস ও চক্ষু রক্ষার গগলসও। জানতে চাইলে পিপিই স্যুটের দাম চাইলেন ২২০ টাকা। নিতে না চাইলে বললেন, মামা ২০০ দিয়েন। শুধু শনির আখড়ায়ই নয়, পুরানা পল্টন, গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ীসহ রাজধানীর অধিকাংশ এলাকার ফুটপাথেই মিলছে এমন সস্তা ও নিম্নমানের সুরক্ষাসামগ্রী। পিপিই পাওয়া যাচ্ছে মহল্লার মুদি দোকানেও। বিক্রি হচ্ছে ফেসবুকে। এ ছাড়া ফেসবুকে অননুমোদিত র‌্যাপিড টেস্টিং কিট বিক্রি করছে একটি প্রতিষ্ঠান। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব পিপিই বা সুরক্ষাসামগ্রীর অধিকাংশই নিম্নমানের। অর্থাৎ এ ধরনের পারসোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট বা পিপিই মোটেও ভাইরাস থেকে সুরক্ষা দিতে পারছে না। তারা বলেন, এ ধরনের পিপিই ব্যবহার বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার আগে পিপিইর ব্যবহার ছিল না বললেই চলে। চিকিৎসকরা স্পর্শকাতর রোগীর চিকিৎসা বা অস্ত্রোপচারের সময় এটি ব্যবহার করতেন। আর ভাইরাস বা জীবাণু ছড়ায় এমন গবেষণায় পিপিইর ব্যবহার করতেন গবেষকরা। তবে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পিপিইর পরিচিতি যেমন বেড়েছে, তেমনই বেড়েছে ব্যবহার। কিন্তু প্রাণঘাতী করোনার সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে এখন শুধু চিকিৎসকই নন, পুলিশ, সাংবাদিক, স্বাস্থ্যকর্মী থেকে শুরু করে সচেতন অনেক সাধারণ মানুষও পিপিই ব্যবহার শুরু করেছেন। একটি পিপিই সেটে পারসোনাল প্রটেকটিভ ক্লথ স্যুট, এক জোড়া গ্লাভস, একটি মাস্ক, এক জোড়া শুজ কভার ও একটি আই প্রটেকটিভ গগলস্্ থাকবে। তবে বাজারে যেসব পিপিই পাওয়া যায়, তা শুধু স্যুট। আর অধিকাংশ দোকানেই বিক্রি হয় নিম্নমানের মাস্ক ও নকল গগলস্।

জানা গেছে, দেশের বাজারে পাওয়া যায়, এমন অধিকাংশ সুরক্ষাসামগ্রীই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসরণ করে তৈরি হয়নি। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান বাজারের ব্যাগ তৈরির কাপড় দিয়েই তৈরি করছে ভাইরাস থেকে রক্ষার অন্যতম সুরক্ষা উপকরণ পিপিই; যা ভাইরাস ঠেকাতে মোটেও কার্যকর নয়। সূত্র জানান, নিজেদের কারখানা সচল রাখতে ও করোনাভাইরাসের এই সময়ে বিপুল মুনাফার আশায় নিম্নমানের এসব পিপিই তৈরি করছে কিছু প্রতিষ্ঠান। অনেকেই এসব কেনার পর মন্তব্য করছেন- এটাকে সাদা রেইনকোট বলাটাই শ্রেয়। অনেক গরম লাগে। অল্পতেই ঘেমে যেতে হয়।

জানতে চাইলে এমন একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমাদের দেশে এখন যে পিপিই পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো শপিংব্যাগের কাপড় দিয়ে তৈরি। এগুলোকে জীবাণুনাশক বলা যাবে না। অন্যরা তৈরি করছে, তাই আমিও তৈরি করছি। তবে বলে নিচ্ছি যে, এগুলোর কোয়ালিটি কিন্তু এমন। এগুলো ভাইরাস প্রটেক্ট করে বলে মনে হয় না।’ এর মধ্যে গত মঙ্গলবার রাজধানীর রাজারবাগ ও নিকুঞ্জে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অননুমোদিত র‌্যাপিড টেস্টিং কিট ও নিম্নমানের সুরক্ষাসামগ্রী উদ্ধার করেছে র‌্যাব। ওইদিন র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ বসু সাংবাদিকদের বলেন, এখানে করোনার র‌্যাপিড টেস্টিং কিট, পিপিই, চিকিৎসা সরঞ্জাম মজুদ করা হয়েছে। অথচ সরকারের বাইরে এসব কারও আমদানির সুযোগ নেই। কারও কাছে থাকারও সুযোগ নেই। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের অনুমোদন ছাড়া আমদানি, মজুদ ও ক্রয়-বিক্রয়ের সুযোগ নেই। এসবের সঙ্গে যারাই জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

বাজারে পাওয়া যাওয়া পিপিই সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘যে পিপিইগুলো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরি করছে এগুলো আসলে খুবই নিম্নমানের। এ ধরনের পিপিই ব্যবহারে বড় ধরনের বিপদ হতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘আসলে অনেক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিভিন্ন হাসপাতালকে পিপিই উপহার দিচ্ছে। এটা আরও বিপদের কথা। কারণ, তারা যে পিপিই দিচ্ছে এগুলো ভাইরাস ঠেকাতে সক্ষম কিনা তা তারা নিজেরাও জানে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভাইরাস ঠেকাতে পারবে মনে করে ব্যক্তিগতভাবে সংগ্রহ করে যারা এ ধরনের পিপিই ব্যবহার করছেন, তারাও ঝুঁকিতে থাকছেন।’

ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আসলে যেসব পিপিই পরে ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া যায় এবং জীবাণুরোধক, সেগুলো অনেক মান নিয়ন্ত্রণ করে তৈরি করা হয়, সেগুলোর দামও বেশি। এখন যে যেভাবে পারছে, পিপিই বানাচ্ছে, বিক্রি করছে। এ ক্ষেত্রে চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে যাচ্ছে। তারা কতটুকু মান নিয়ন্ত্রণ করে তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। কারণ, জীবাণু রোধে যে কোয়ালিটি রক্ষা করা দরকার, অধিকাংশই তা করছে না।’ এ ধরনের অসাধু ব্যবসায়ীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর