মঙ্গলবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

বিদেশ যেতে অপেক্ষায় দেড় লাখ প্রবাসী

মধ্যপ্রাচ্যে চাকরিজীবীরাই সবচেয়ে বেশি সংকটে ভিসা বিমান টিকিট নিয়েও আটকা

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের রফিকুল। প্রায় চার বছর চেষ্টার পর মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশের ভিসা হাতে পান মার্চের প্রথম সপ্তাহে। বিমান টিকিটের দাম ও অন্যান্য খরচ দেখিয়ে দালাল তার কাছে নিয়েছে প্রায় ছয় লাখ টাকা। কৃষি জমি বিক্রি ও ধার কর্জ করে এই টাকা জোগান দিয়েও খুশি রফিকুল। কারণ তার বিমানের ফ্লাইট মার্চের শেষ সপ্তাহে। ভিসা ও টিকিট সবই হাতে। প্রবাসে কাজটাও নিশ্চিত। কিন্তু এর মধ্যেই বাদ সাধে করোনাভাইরাস। বন্ধ হয়ে যায় সব ধরনের বিমান যোগাযোগ। অনিশ্চয়তা ভর করে রফিকুলের জীবনে। শুধু রফিকুল নন, করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে আটকে গেছে তার মতো দেড় লাখ শ্রমিকের বিদেশ যাত্রা। বিদেশিদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করায় মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে ভিসা প্রস্তুত হওয়ার পরও প্রায় দেড় লাখ কর্মীর  বিদেশে যাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এই সময়ে যারা দেশে ফিরেছিলেন তাদের যাওয়াও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার কারণে। তবে করোনাভাইরাসের এই সংকটকালে যাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে তাদের মেয়াদ বাড়াতে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন পক্ষ থেকে। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, ‘তিনটি ধাপে আমাদের দেড় লাখ শ্রমিকের বিদেশ যাওয়া আটকে গেছে। প্রথমত, যাদের সমস্ত কার্যক্রম (স্মার্টকার্ড, ইমিগ্রেশন, মেডিকেল) সম্পন্ন হয়েছে তারা ফ্লাইট বন্ধ হওয়ার কারণে যেতে পারছে না। দ্বিতীয়ত, যাদের ভিসা সম্পন্ন হলেই যেতে পারবে। তৃতীয়ত, যেসব শ্রমিকের চাহিদা ইস্যু করা হয়েছে সেগুলো প্রস্তুত করা হচ্ছে। শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান আরও বলেন, ‘সবাই পোশাক খাত নিয়ে কথা বলছেন। করোনাভাইরাসের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি হলে আগামী মাস থেকে আমাদের এই খাত চালাতে পারব কিনা সন্দেহ আছে। আমাদের কাছে যে দেড় লাখ ভিসা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে, সেখানে বড় ধরনের বিনিয়োগ করা হয়েছে। লোক পাঠাতে না পারলে আমরা এই টাকা আদায় করতে পারব না।’ জানা যায়, সৌদি আরব বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার। দেশটিতে ৪০ লাখের মতো বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করেন। করোনাভাইরাস ঠেকাতে সৌদি সরকার বিদেশিদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। সে কারণে দেশটিতে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে কর্মী পাঠানো বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু সৌদি আরব নয়, কুয়েত, ওমান, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও চলছে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা। এর ফলে ভিসার সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পরও বিদেশে কাজ করতে যেতে পারছেন না কোনো বাংলাদেশি। করোনাভাইরাসের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি হলে বিদেশের শ্রমবাজারে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। কারণ শুধু নতুন কর্মীরা নন, বিপাকে পড়েছেন ছুটিতে আসা অনেকে। এরই মধ্যে তাদের ভিসার মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে। এতে অনেকেই চাকরি হারানোর শঙ্কায় পড়েছেন। এমতাবস্থায় ভিসার মেয়াদ বাড়াতে দূতাবাসগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমেদ বলেন, ‘অনেক দেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনা করবেন তারা।’ প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিদেশে শ্রমিক যাওয়া কমে গেছে ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই। জানুয়ারিতে যে সংখ্যক শ্রমিক বিদেশে গেছেন, ফেব্রুয়ারিতে তার ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ কম। জানুয়ারিতে কর্মী হিসেবে বিদেশে গেছেন ৬৯ হাজার ৯৯৮ জন আর ফেব্রুয়ারিতে গেছেন ৫৯ হাজার ১৩৯ জন।’ করোনাভাইরাসের প্রভাবে কমে গেছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে দেশে এসেছে ৩৮ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স। দ্বিতীয় সপ্তাহে এসেছে ৪২ দশমিক ৫ কোটি ডলার। তৃতীয় সপ্তাহে সেটি কমে ২৬ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। চলতি মাসের প্রথম ১৯ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ১০৭ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে এসেছে ১ হাজার ২৫০ কোটি ডলার।

ক্ষতিগ্রস্ত অভিবাসীকর্মীর পরিবারের জন্য বিশেষ ‘সামাজিক সুরক্ষা’ ঘোষণার দাবি : বিশ্বব্যাপী মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের কারণে বিদেশফেরত এবং বিদেশে অবস্থানরত ক্ষতিগ্রস্ত অভিবাসীকর্মীর পরিবারের জন্য বিশেষ ‘সামাজিক সুরক্ষা’ ঘোষণার দাবি জানিয়েছে অভিবাসীকর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম (ওকাপ)। তারা বলছে, অভিবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখে। তাই এই সময়ে তাদের পাশে দাঁড়ানো সবার দায়িত্ব ও কর্তব্য। ওকাপ সভাপতি শাকিরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, নিয়মিত ও অনিয়মিত মিলিয়ে বাংলাদেশের প্রায় দুই কোটি অভিবাসী কর্মী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্মরত। এসব অভিবাসীকর্মীর কষ্টার্জিত রেমিট্যান্স (প্রতি বছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার) বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের সবচেয়ে বড় শক্তি।

 কভিড-১৯-এর চলমান বৈশ্বিক মহামারীর কারণে অধিকাংশ অভিবাসীকর্মী ক্ষতিগ্রস্ত। আশঙ্কা করা হচ্ছে, কভিড-১৯-এর কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক মন্দার কারণে বিভিন্ন দেশ থেকে কয়েক লাখ শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে দেশে ফিরতে বাধ্য হবে। এ ছাড়া চলমান মহামারীর কারণে বিদেশে অবস্থানরত অভিবাসীকর্মী অনেকেই কর্মহীন হয়ে পড়েছে অথবা বেতন পাচ্ছেন না। বিগত এক মাস ওকাপ পরিচালিত হেল্পলাইন ‘ডাটাবেজ’ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিদেশে অবস্থানরত অভিবাসীকর্মীর প্রায় ৪০ শতাংশ চলমান ‘লকডাইন’ পরিস্থিতিতে কাজ না থাকা বা বেতন না পাওয়ার কারণে নিজেরা মানবেতর জীবনযাপন করছে। এ ছাড়া বিদেশ থেকে টাকা না পাঠানোর কারণে এসব কর্মীর প্রায় ২৫ শতাংশ পরিবার চরম সংকটে পড়েছে। অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। অনেকে বিভিন্ন অসুস্থতায় ওষুধ কিনতে না পেরে আরও বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। একদিকে এই সব অভিবাসীকর্মীর সামাজিক অবস্থানের কারণে সরকারি বা বেসরকারিভাবে পরিচালিত কোনো খাদ্য সহায়তা গ্রহণ করতে পারছে না। অন্যদিকে হতদরিদ্র বা নিম্ন আয়ের মানুষের দলে না পড়ার কারণে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ৫০ লাখ মানুষের ‘রেশন কার্ডের’ যে তালিকা তৈরি হচ্ছে, তা থেকেও বাদ দেওয়া হচ্ছে। এই অবস্থায় বিদেশফেরত এবং বিদেশে অবস্থানরত ক্ষতিগ্রস্ত অভিবাসীকর্মীর পরিবারের খাদ্য নিরাপত্তা, কল্যাণ ও সুরক্ষা নিশ্চিতে বিশেষ ‘সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী’ ঘোষণার জোর দাবি জানাচ্ছে অভিবাসীকর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর