বুধবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

বস্ত্র-পোশাক রপ্তানিতে ধসের আশঙ্কা

দেড় হাজারের বেশি বস্ত্র ও পোশাক কারখানা খুলছে, পর্যায়ক্রমে খুলবে সব গ্রামের শ্রমিক না আসার পরামর্শ, বন্ধ হচ্ছে আন্তর্জাতিক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান

রুহুল আমিন রাসেল

বাংলাদেশি পোশাকপণ্যের বড় প্রতিযোগী চীন, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া খুলেছে কারখানা। একের পর এক সচল তাদের কারখানার উৎপাদন। বৈশ্বিক বাজার বাস্তবতা ও শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তায় এখনই বাংলাদেশের কারখানাগুলো উৎপাদনে না গেলে রপ্তানিতে বড় ধরনের ধসের আশঙ্কা করছেন বস্ত্র ও পোশাকশিল্পের মালিকরা।

বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমএ সূত্র জানায়, ইতিমধ্যে পোশাকশিল্পে ৩ দশমিক ১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের ক্রয়াদেশ বাতিল করেছেন ক্রেতারা। চলমান ক্রয়াদেশ বাতিলের পাশাপাশি আছে আরও ক্রেতা হারানোর শঙ্কা। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে ১ হাজার ৫৭৫টি কারখানা খুলেছে। এর মধ্যে বিজিএমইএর সাড়ে ৬০০, বিটিএমএর প্রায় ৭০০ ও বিকেএমইএর ২২২টি সদস্য কারখানা রয়েছে। সব মিলিয়ে ১ হাজার ৫৭২টি কারখানা খুলেছে। ১ মের পর পর্যায়ক্রমে খুলবে সব কারখানা। তবে গ্রামের শ্রমিকদের না আসারও পরামর্শ দিয়েছেন মালিকরা। শিল্পপুলিশ জানিয়েছে, দেশের ছয় শিল্প এলাকায় সব খাত মিলিয়ে গতকাল পর্যন্ত মোট ২ হাজার ৯১৬টি কারখানা খুলেছে। আর বন্ধ আছে ৪ হাজার ৬৮৬টি। এর মধ্যে বিজিএমইএর সদস্য কারখানা ৯৯৩টি, বিকেএমইএর ৩২৭টি এবং ইপিজেডের ২০৮টি কারখানা রয়েছে। সব মিলিয়ে ১ হাজার ৫২৮টি পোশাক কারখানা খোলার তথ্য দিয়েছে শিল্পপুলিশ। এ প্রসঙ্গে পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ড. রুবানা হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অর্থনীতি সচল রাখার স্বার্থে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পর্যায়ক্রমে সব কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যে কোনো মালিক ইচ্ছা করলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে তার কারখানা চালু করতে পারবেন। স্বাস্থ্যবিধি না মেনে একটি কারখানাও খোলা হবে না। বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘স্বাস্থ্যবিধি মেনে ২২২টি নিট পোশাক কারখানা খোলা হয়েছে। কারণ জীবন-জীবিকার সন্ধানে আমাদের নামতে হবে। করোনাভাইরাসে স্থবির অর্থনীতির চাকা সচল করতে হবে। তাই স্যাম্পল, নিটিং ও ডায়িং সেকশন চালু করতে আমরা সব সদস্য কারখানাগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছি। এসব সেকশনে খুবই কমসংখ্যক শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। ফলে খুব সহজেই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা যাবে। অন্যদিকে সুইং বা সেলাইসহ অন্যান্য সেকশন ১ মের পর পরিস্থিতি বুঝে চালু করতে পারবে কারখানাগুলো। তবে গ্রামের শ্রমিকদের না আসার অনুরোধ করছি।’ বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, বস্ত্রশিল্পের প্রায় দেড় হাজার কারখানার মধ্যে ৭০০ কারখানা খুলেছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে পর্যায়ক্রমে সব কারখানা খুলবে। জানা গেছে, চীনের পরিচিতি বিশ্বের কারখানা হলেও পোশাকের বাজারে তাদের পরে আছে বাংলাদেশ, ভিয়েতনামের নাম। গত কয়েক মাসে করোনাভাইরাসের কারণে সারা বিশ্বেই ব্যাহত হয়েছে উৎপাদন। ইউরোপ, আমেরিকার দেশগুলো আক্রান্ত হওয়ায় বাতিল হয়েছে ক্রয়াদেশ। করোনার প্রভাব কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে ক্রেতা দেশগুলো। তাদের চাহিদা সামাল দিতে এরই মধ্যে কারখানা চালু করেছে চীন, ভিয়েতনামের মতো বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগীরা। তাই এখনই উৎপাদনে না গেলে বাংলাদেশি পোশাকপণ্যের বিশ্ববাজার চলে যেতে পারে ওই প্রতিযোগীদের হাতে। দেখা দিতে পারে স্থায়ী সংকট। বিজিএমইএ দাবি করছে, গত এক মাস কিছু কারখানা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালু থাকলেও কোনো সংক্রমণ হয়নি। তাই এখন সীমিত পরিসরে কারখানা চালু করা গেলে গ্রীষ্মের ক্রয়াদেশ পূরণ করে শরৎ ও শীতের কার্যাদেশ পাওয়া যাবে। আর যেসব পোশাক কারখানা চালু হবে, তাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা অনুযায়ী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মালিকদের নির্দেশনাও দিয়েছে বিজিএমইএ। এ প্রসঙ্গে সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, ‘সমানে কারখানা খোলা হচ্ছে। শ্রমিকদের বাড়ি থেকে ফোন করে ও এসএমএস পাঠিয়ে আনা হচ্ছে। বলা হচ্ছে কারখানার বাইরে যারা থাকবেন, তাদের বেতন দেওয়া হবে না। মালিকরা অনেক ধরনের রং-তামাশা করছেন। শ্রমিকরা জানিয়েছেন, কারখানাগুলোতে সামাজিক সুরক্ষা নেই। লে-অফ ঘোষণা ও শ্রমিক ছাঁটাই চলছে সমানতালে। আমার অনুরোধ, মালিক ও ক্রেতারা কারখানায় থাকুক। তখন তারা বুঝবেন পোশাক কারখানাগুলোতে কী সুরক্ষা ব্যবস্থা আছে।’

জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, সারা দেশের সব পোশাক কারখানাই খুলেছে। তবে ঢাকায় আংশিক খুলেছে। এসব কারখানায় শ্রমিকরা আগের মতোই দুই শিফটে কাজ করছেন।

গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের (টিইউসি) সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বলেন, ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ পোশাক কারখানা খুলেছে। অধিকাংশ কারখানায় শ্রমিকদের সুরক্ষা নেই। তাপমাত্রাও মাপা হচ্ছে না। ছুটির সময়টাকে বিভিন্ন কারখানায় ইউনিট ধরে লে-অফ ঘোষণা ও শ্রমিক ছাঁটাই চলছে। আবার বেশ কিছু কারখানা এখনো মার্চ মাসের বেতন পরিশোধ করেনি বলে অভিযোগ করেন এই পোশাক শ্রমিক নেতা। এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে শিল্পপুলিশ সদর দফতরের পুলিশ সুপার (অপারেশন ও গোয়েন্দা) মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন বলেন, আশুলিয়ার তিনটি কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটেছে। এ কারখানাগুলো হলো মার্স ডিজাইন লিমিটেড, সততা কম্পোজিট ও হ্যাপি নেস্ ডেনিম ফ্যাশন লিমিটেড। এ ছাড়া চট্টগ্রামের আল-আমিন গার্মেন্টস লিমিটেডের শ্রমিকদের মার্চ মাসের বেতন মালিক কেটে রাখায় কারখানার সামনে শ্রমিক অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। পরে কারখানাটির ৬০ শতাংশ শ্রমিক বেতন গ্রহণ না করে নিজ নিজ গন্তব্যে চলে যান। তবে মালিকপক্ষ আজ বেতন পরিশোধের কথা বলেছে। ঘটনাস্থলে কলকারখানা অধিদফতর ও বিজিএমইএর কোনো প্রতিনিধি ছিলেন না। জানা গেছে, স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে পোাশাক কারখানা মালিকরা সবাই একমত হয়েছেন। ধাপে ধাপে তারা দেশের সব কারখানা চালু করবেন। এমনকি কোনো শ্রমিক করোনায় আক্রান্ত হলে দ্রুত চিকিৎসা দেওয়ার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আক্রান্ত শ্রমিকের তথ্য দেওয়ার জন্য চালু করা হয়েছে হটলাইন। পাশাপাশি চারটি জোনে ভাগ করে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। চালু হওয়া কারখানাগুলো স্বাস্থ্যবিধি মানছে কিনা তা দেখার জন্য মনিটরিং সেল গঠন করা হয়েছে। বিজিএমইএ প্রাথমিকভাবে কারখানার কাছাকাছি বসবাসকারী শ্রমিকদের কাজে নিয়োগের জন্য মালিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। করোনার বিরুদ্ধে লড়াই শেষ না হওয়া পর্যন্ত সম্প্রতি গ্রাম থেকে ফিরে আসা শ্রমিকদের কারখানায় প্রবেশের অনুমতি না দেওয়ারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া কারখানাগুলোর ভিতরে প্রত্যেককে মাস্ক পরতে হবে। বিজিএমইএ পরামর্শ দিয়েছে যে কারখানাগুলোর প্রবেশমুখে হাত ধোয়া, জুতা ও যানবাহনে জীবাণুনাশক স্প্রে করা এবং শরীরের তাপমাত্রা স্ক্যান করার মতো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সহসভাপতি ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘যেসব কারখানা স্বাস্থ্যবিধি মানতে পারছে, কেবল তারাই খুলছে। তারাই খুলবে। কোনো শ্রমিক যাতে অসুস্থ না হন সে ব্যাপারে সব মালিক সতর্ক আছেন। অর্থনীতি সচল রাখার স্বার্থে, শ্রমিকদের খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার স্বার্থে, আমরা কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ এদিকে করোনাভাইরাসের ভয়াবহ ধাক্কা খেয়ে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো যখন পুনরায় উৎপাদন শুরু করতে যাচ্ছে, তখন লোকসানের ভারে দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম পোশাকপণ্যের আন্তর্জাতিক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হচ্ছে। বাংলাদেশি পোশাকপণ্যের অন্যতম ক্রেতা দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান জেসি পেনি বেশ কিছু বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধ করেছে। বিশ্বের বড় বড় অনেক ব্র্যান্ডও নাজুক পরিস্থিতিতে আছে। সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রে জেসি পেনি দেউলিয়া হতে চেয়েছে।

কভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার বেশ আগে ২০১৯ সালের অক্টোবরে পোশাকশিল্পের বৈশ্বিক ও স্থানীয় প্রেক্ষাপট নিয়ে সমীক্ষা করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রাইসওয়াটারহাউসকুপারস (পিডব্লিউসি)। সমীক্ষায় বলা হয়, ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে দেউলিয়া হতে চেয়েছে ব্রাজিলের কিকো। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে বন-টন, মার্চে সাউদার্ন গ্রোসার্স, এপ্রিলে নাইন ওয়েস্ট ওয়েস্ট, মে মাসে রকপোর্ট, আগস্টে বরুকস্টোন, অক্টোবরে সিয়ার্স ও নভেম্বরে ডেভিডস ব্রাইডাল দেউলিয়া হতে চেয়ে আবেদন করে। আর চলতি বছর দেউলিয়া হতে চাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিউটি ব্র্যান্ডস, ফুল বিউটি ব্র্যান্ডস।

সর্বশেষ খবর