শুক্রবার, ১ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনায় সাড়ে ৬ কোটি শ্রমিকের চাপা কান্না

আজ মহান মে দিবস

রুহুল আমিন রাসেল

করোনায় সাড়ে ৬ কোটি শ্রমিকের চাপা কান্না

করোনাভাইরাস সংক্রমণের দিনগুলোয় চরম দুঃসময় পার করছেন শ্রমিকরা। সারা দেশের ৬ কোটি ৩৫ লাখ শ্রমিকের বুকে এখন চাপা কান্না। রক্ত-ঘাম নিংড়ানো, হাড় ভাঙা খাটুনি যাদের জীবন সেই শ্রমিকের এ কান্না কেউ শোনে না। শ্রমিকের রক্ত ঝরানো ঘামের আড়ালে চাপা পড়া কষ্ট কেউ বোঝে না। সারা বছর অভাব-অনটনে জর্জরিত শ্রমিকদের হাতে এখন নেই কোনো কাজ। ঘরে নেই খাবার। করোনার ছুটিতে এক মাসের বেশি সময়ে শ্রমিকরা বেকার। এমনই চরম দুর্দিনে আছে বাংলাদেশের শ্রমিকসমাজ। আজ মহান মে দিবস ২০২০। ১৩৪তম আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি ও বিজয় উৎসবের এই দিন উপলক্ষে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এবারের মে দিবসে সব কর্মসূচি স্থগিত করা হলেও বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন অনলাইনে দিবসটি পালনের ঘোষণা দিয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএসের সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্যমতে, দেশে মোট কর্মোপযোগী মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি ৯১ লাখ। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশে ৬ কোটি ৩৫ লাখ শ্রমশক্তি রয়েছে। এর মধ্যে পুরুষ ৪ কোটি ৩৫ লাখ ও নারী ২ কোটি। কর্মক্ষম জনশক্তির মধ্যে ৬ কোটি ৮ লাখ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত রয়েছে।

এবারের মে দিবসে কেমন আছেন শ্রমিকরা, জানতে চাইলে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতারা গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনাভাইরাসের এই সময়ে সমস্যার শেষ নেই শ্রমিকের। তারা এক ঘরে থাকেন পাঁচ থেকে ছয় জন। ফলে সামাজিক সুরক্ষা তাদের নেই। ঘরে নেই খাবার। ত্রাণও পাচ্ছেন না শ্রমিকরা। গার্মেন্ট, আবাসন, কনস্ট্রাকশন, পরিবহন, কৃষি থেকে শুরু করে সর্বস্তরের শ্রমিকরা এখনো ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ ও ন্যায্য মজুরির বঞ্চনা নিয়েই কাজ করছেন। এমনকি কাজ করেও শ্রমিকরা বেতন পাচ্ছেন না। তারা বলেছেন, প্রতি বছর মহান মে দিবসে আলোচনা হয়। কিন্তু শ্রমিকের সংকটের সমাধান কোনোভাবেই হয় না। কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা, শিল্পবিরোধ, স্বাস্থ্য সমস্যা, বকেয়া মজুরি, বিনা নোটিসে ছাঁটাই, নারী শ্রমিকদের যৌন হয়রানিসহ ঘাটে ঘাটে সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। এমন বাস্তবতায় আজ দেশে পালিত হচ্ছে মহান মে দিবস। ১৩৪ বছর আগে আমেরিকার হে মার্কেটে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় ১ মে ‘মহান মে দিবস’ বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি এবং বিজয় উৎসবের দিন হিসেবে। বাংলাদেশও শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে পালন করে মহান মে দিবস। তবে দিবস পালনের আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে যায় শ্রমিকের প্রাপ্যতা। প্রাধান্য পায় না শ্রমিকের মৌলিক অধিকারের বিষয়টি, এমনটাই মনে করেন শ্রমিকনেতারা। তাদের মতে, প্রতিনিয়ত লাখ লাখ শ্রমিক শ্রমবঞ্চনার শিকার হয়। উপেক্ষিত থাকে শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার। ফলে শ্রমিকদের কাজের নিশ্চয়তা, বাসস্থান, চিকিৎসাসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় বিষয় আড়ালেই থাকে। যদিও ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৮ ঘণ্টা শ্রম, ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম এবং ৮ ঘণ্টা বিনোদন, পাশাপাশি শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি ও সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার সূচনার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মহান মে দিবস’। বাংলাদেশের শ্রমিকরা এর কোনোটাই ভোগ করতে পারেন না বলে মনে করেন শ্রমিকনেতারা।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র-টিইউসির সাধারণ সম্পাদক প্রখ্যাত শ্রমিকনেতা ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান বলেন, করোনা সংকটে ৬ কোটির বেশি শ্রমিক এখন দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন। তাদের কাজ নেই। ঘরে খাবার নেই। স্বাস্থ্য সুরক্ষা পরিবেশ নেই। সামাজিক দূরত্বও নেই। আগামীতে অনেক শ্রমিক না খেয়ে মারা যাবেন। এখন শ্রমিকদের চাকরি অনিশ্চিত। ছাঁটাই চলছে। কারখানা লে-অফ করা হচ্ছে। ছাঁটাই ও লে-অফ বন্ধ করে ঈদের আগে শ্রমিকদের বকেয়া বেতন-ভাতা প্রদানসহ বিশেষ প্যাকেজ দিতে হবে। এটা সরকার দ্রুত করতে না পারলে সামনে বিপদ বাড়বে। গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি অ্যাডভোকেট মন্টু ঘোষ বলেন, চলমান বৈশ্বিক মহামারী শাসক ও শোষকদের জুলুমের চেহারা উন্মোচিত করেছে। একদিকে মুনাফার চাপে শ্রমিককে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে চিকিৎসাব্যবস্থার বাণিজ্যিকীকরণ চূড়ান্ত আকার ধারণ করেছে। এমন পরিস্থিতিতে মহামারীর সময়ে ছয় মাস সব লে-অফ, ছাঁটাই, চাকরিচ্যুতি নিষিদ্ধ ঘোষণার গেজেট প্রকাশ করতে হবে। বেতনের ৪০ শতাংশ কেটে রাখার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে হবে।

জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, শ্রমিকদের অবস্থা সব সময়ই খারাপ। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা দিন আনে দিন খায়। এক কথায় শ্রমিকরা অমানবিক ও ভয়াবহ দিন কাটাচ্ছেন। তাদের ঘরে শান্তি নেই।

তবে জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি ফজলুল হক মন্টু বলেন, শ্রমিকরা এখন খুবই ভালো আছেন। তবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন শ্রমিকদের ত্রাণ দেওয়ার ব্যাপারে। এদিকে করোনা পরিস্থিতির বিদ্যমান বাস্তবতায় করণীয় নির্ধারণে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবসংক্রান্ত পত্র দিয়েছে শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ-স্কপ। সম্প্রতি প্রতিমন্ত্রীকে দেওয়ায় ওই প্রস্তাবে দেশের শ্রমিক- কর্মচারীদের নেতৃত্বদানকারী জাতীয় ফেডারেশনের মোর্চা স্কপ বলেছে, বর্তমানের করোনা সমস্যা কারও একার নয়। এটি সামাজিক সমস্যা। সমাজের নারী, পুরুষ, হিজড়ানির্বিশেষে সব মানুষের যেমন দায় আছে, তেমন দায়িত্বও আছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক সব ক্ষেত্রেই শ্রমিকরা নিদারুণ কষ্টের মধ্যে আছেন। ভয় ও আতঙ্কের ভিতর দিয়ে হতাশ হচ্ছেন। সংক্ষুব্ধতা ও বিক্ষোভ বেড়ে সহিংসতার ঝুঁকি সৃষ্টি হচ্ছে। তাই এ সংকট উত্তরণের জন্য সঠিকভাবে পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে পরিস্থিতির ক্রমাবনতির সম্ভাবনা রয়েছে। এ পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

স্কপ গত ৩ এপ্রিল দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর ৩১ দফা নির্দেশনা ঘোষণার আলোকে কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়ে বলেছে, চিকিৎসক, নার্স, ল্যাব টেকনিশিয়ান, পরিচ্ছন্নতা কর্মী ও অ্যাম্বুলেন্স চালকসংশ্লিষ্ট সবার স্বাস্থ্য সুরক্ষা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেখতে হবে। স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে সবার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ ব্যক্তিগত সুরক্ষা পোশাক বা পিপিই সরবরাহ, স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনা, মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণের পরিমাণ ঘোষণা, পরিবারকে সহায়তা প্রদান, সামাজিক ও প্রশাসনিক নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত ও জোরদার করতে হবে।

স্কপ বলেছে, শ্রমিকদের বেতন বা মজুরি পরিশোধ, পরিবারকে অর্থ প্রেরণের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান, নিরাপদ থাকার ব্যবস্থা, সামাজিক ও প্রশাসনিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। পাটকল, চিনিকল, বস্ত্রকলসহ রাষ্ট্রায়ত্ত কলকারখানা প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধ ও নিয়মিত মজুরি পরিশোধ ব্যবস্থা চালু করতে হবে। ব্যক্তিমালিকানাধীন যেসব কারখানা, প্রতিষ্ঠান, পরিবহন ও অন্যান্য কার্যক্রম বিদ্যমান পরিস্থিতির কারণে বন্ধ রয়েছে, তাদের বকেয়াসহ নিয়মিত মজুরি ও বেতন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পরিশোধ করা হোক। সব শ্রমিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্যবিমা বা সেন্ট্রাল ফান্ড থেকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হোক।

স্কপ বলেছে, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের বিনামূল্যে খাদ্য, ওষুধ, অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীসহ আনুষঙ্গিক সকল প্রকার সহায়তা প্রদানের জন্য ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে শ্রমিক ইউনিয়নসমূহকে সম্পৃক্ত করে কমিটি গঠন করে সরকারি সহায়তা করতে হবে। প্রয়োজনে ট্রেড ইউনিয়নসমূহের কর্মীদের নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করতে হবে। শ্রমিকদের জন্য ন্যায্যমূল্যে টিসিবির পণ্য দিতে হবে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে মনিটরিং সেল গঠন করা হোক। অসংগঠিত শ্রমিক, দিনমজুর এবং কৃষক, খেতমজুর শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষের তালিকা করে একই ধরনের সহায়তাদানে সরকারি পর্যায়ে সরাসরি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর