শুক্রবার, ১ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

ছুটির এক মাসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সংঘর্ষে নিহত ৫ আহত তিন শতাধিক

মোশাররফ হোসেন বেলাল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

লকডাউনের ছুটিতে গত এক মাসে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় ২০টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন কোলের শিশুসহ পাঁচজন। এসব ঘটনায় পুলিশ, নারীসহ তিন শতাধিক আহত হয়েছেন। বাড়িঘরে ভাঙচুর ও লুটপাট চালানোর পাশাপাশি বসতঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। পুলিশকে এ সময় লাঠিচার্জ, টিয়ার শেল, রাবার বুলেট ছুড়ে সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। এসব ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে এক ইউপি চেয়ারম্যান, উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদকসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি গ্রেফতার হয়েছেন। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিল নবীনগর উপজেলায় পা কেটে হাতে নিয়ে প্রকাশ্যে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়ার ঘটনা। ১২ এপ্রিল উপজেলার কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের থানাকান্দি গ্রামে পূর্ববিরোধকে কেন্দ্র করে এ সংঘর্ষে পা কেটে নেওয়া ব্যক্তি মোবারক মিয়া মারা যান। করোনায় সরকারি ছুটি ঘোষণার পর ২৬ মার্চ থেকে ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত এক মাসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এ সংঘর্ষগুলো হয়।

সর্বশেষ বুধবার সকালে সরাইলের কাটানিশার গ্রামে মসজিদে যাওয়া নিয়ে দুই পক্ষের সংঘর্ষে অর্ধশত লোক আহত হন। এর দুই দিন আগে ২৭ এপ্রিল নাসিরনগরের গোকর্ণ গ্রামে বাড়ির রাস্তা নিয়ে হামলায় ২ মাস ১০ দিন বয়সী শিশু ফারিয়া নিহত হয়। জেলা সদরসহ প্রতিটি উপজেলাতেই তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘটেছে এসব সংঘর্ষ। ধানের ওপর দিয়ে ট্রাক্টর যাওয়া, এক বাড়ির হাঁস আরেক বাড়িতে যাওয়া, কথাকাটাকাটি, বাড়ির সীমানা ও রাস্তা নিয়ে বিরোধসহ ছোটখাটো কারণে এসব সংঘর্ষ হয়। হামলার সর্বশেষ বলি ফারিয়া নামের সেই ২ মাস ১০ দিন বয়সী শিশু। ২৭ এপ্রিল সন্ধ্যায় উপজেলার গোকর্ণ ইউনিয়নের গোকর্ণ গ্রামে হত্যার শিকার হয় বরিশালের বাকেরগঞ্জের শ্যামপুর গ্রামের রাজু মিয়ার মেয়ে ফারিয়া। প্রবাসী রাজু মিয়ার স্ত্রী নাইমা বাবার বাড়ি নাসিরনগরেই থাকতেন। শিশু ফারিয়ার আত্মীয় কাবির মিয়ার স্ত্রী জোসনা বেগমের সঙ্গে রাস্তা নিয়ে প্রতিবেশী জসিম মিয়ার কথাকাটাকাটির জেরে এ হামলা হয়। নবীনগরের কৃষ্ণনগর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমান ও এলাকার সর্দার আবু কাউছার মোল্লার মধ্যে বিরোধের জের ধরে ১২ এপ্রিল থানাকান্দি গ্রামে সংঘর্ষে অন্তত ৩০ জন আহত হন। এ সংঘর্ষ চলাকালে মোবারক মিয়া নামে এক ব্যক্তির পা কেটে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়া হয়। পরে মোবারক মিয়া মারা যান। এ ঘটনায় জিল্লুর রহমান ও কাউছার মোল্লাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ৩ এপ্রিল নাসিরনগরে হত্যার শিকার হয়েছেন নাসিরনগর উপজেলার কদমতলী গ্রামের সোলেমান মিয়ার ছেলে ও গোয়ালনগর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক মেম্বার মোস্তফা কামাল ওরফে মস্তু মিয়া (৬০)। ওই দিন সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে বের হয়ে গ্রামের পশ্চিম দিকে গিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলার সময় অতর্কিত হামলার শিকার হন মোস্তফা কামাল। ৪ এপ্রিল সকালে কসবায় খুন হন উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামের মো. সলিমুল্লাহর ছেলে মো. তানভীর (২২)। পূর্ববিরোধ ও মাটি কাটা নিয়ে ঝগড়ার জের ধরে প্রতিপক্ষের হামলায় তানভীর খুন হন বলে পরিবারের লোকজন অভিযোগ করেছেন। জেলার আশুগঞ্জ উপজেলা সদরের মুন্সী মার্কেটের সামনে ২৭ মার্চ প্রতিপক্ষের হামলায় মো. জাহাঙ্গীর আলম (৫১) নিহত হয়েছেন।

নিহত জাহাঙ্গীর উপজেলার চরচারতলা গ্রামের মো. ইলু মিয়ার ছেলে। মুন্সী মার্কেটের পাশে একটি পোড়া গুদামে জুয়ার আসরে তিনি হামলার শিকার হন। জেলার সবচেয়ে দাঙ্গাপ্রবণ এলাকা সরাইলে ৫ এপ্রিল এক দিনেই উপজেলার টিঘর, বড়ইছড়া, বিটঘর, নোয়াগাঁও, ধরন্তী, সৈয়দটুলা এলাকায় সাতটি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বড়ইছড়ায় অর্ধশতাধিকসহ এসব সংঘর্ষে শতাধিক লোক আহত হন। ওই দিন বিকালে মার্বেল খেলা নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পৌর এলাকার দক্ষিণ পাড়ায় দুই গুষ্টির সংঘর্ষে অন্তত ১৫ জন আহত হন। সংঘর্ষে মোজাহিদ নামে এক যুবকের ডান চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। ৩১ মার্চ সরাইল উপজেলার পাণীশ্বর ইউনিয়নের ভূঁঈশ্বর গ্রামে দুই দল গ্রামবাসীর সংঘর্ষে উভয় পক্ষের অর্ধশতাধিক লোক আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশকে ২৬ রাউন্ড রাবার বুলেট ও ১০ রাউন্ড টিয়ার শেল ছুড়তে হয়। ২৬ মার্চ বিজয়নগরের সিঙ্গারবিল ইউনিয়নের নোয়াগাঁও গ্রামে দুই পক্ষের মধ্যে হওয়া সংঘর্ষে ২০ জন আহত হন। একই উপজেলার আদমপুরে ২৬ এপ্রিল পাওনা টাকার জেরে দুই পক্ষের সংঘর্ষে ৩০ জন আহত হন। ১১ এপ্রিল বাঞ্ছারামপুর উপজেলার সোনারামপুর ইউনিয়নের শান্তিপুর গ্রামে পূর্ববিরোধের জের ধরে সংঘর্ষে অন্তত ৩০ জন আহত হন। একই দিন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিকে খাজানগর এলাকার কবরস্থানে দাফন করতে গিয়ে হামলার শিকার হয় পুলিশ। পরদিন সরাইল উপজেলার নোয়াগাঁও ইউনিয়নের আঁখিতারা গ্রামে দুই পক্ষের সংঘর্ষে ৩০ জন আহত হন। সংঘর্ষের নেপথ্যে এলাকা ও বংশগত প্রভাব বিস্তার এবং জনপ্রতিনিধিদের ইন্ধন ও কলকাঠি নাড়ে বলে অভিযোগ রয়েছে। সংঘর্ষপ্রবণ এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রমের পাশাপাশি গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানোর দাবি তুলেছে সুধী সমাজ।

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর