রবিবার, ৩ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনায় বিপর্যস্ত শিক্ষা খাত

সেশনজটের আশঙ্কা অনলাইন ক্লাসে জোর দিচ্ছে সরকার

আকতারুজ্জামান ও জয়শ্রী ভাদুড়ী

করোনার ছোবলে বিপর্যস্ত দেশের শিক্ষা খাত। দেড় মাস ধরে বন্ধ রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। স্থগিত হয়েছে এইচএসসি পরীক্ষা। এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের কথা ছিল এ সপ্তাহে। করোনা মহামারীতে প্রকট হচ্ছে সেশনজটের আশঙ্কা। পিছিয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। সংকট সমাধানে অনলাইন ক্লাসের ব্যাপ্তি বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে সরকার। এ ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, ‘শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি আমরা। তাই সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ার পরই স্কুল-কলেজে যাবে ছাত্রছাত্রীরা। যে সংকট শুরু হয়েছে তাতে আমরা বলতে পারছি না যে কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। তা জানলে সে হিসেবে ব্যবস্থা নিতাম।’

তিনি আরও বলেন, ‘অনিশ্চয়তা থাকায় শিক্ষার্থীদের স্কুলে পাঠানো যাচ্ছে না। যদি করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হয় তবে টানা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্ধ থাকবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যেভাবে সংসদ বাংলাদেশ টেলিভিশন ও অনলাইনে ক্লাস কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে এটি চলমান থাকবে। রমজান ও ঈদের পরে এসব ক্লাসের পরিসীমা বিস্তৃত করা হবে। আরও কীভাবে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা যায় সেসব নিয়েও ভাবছি আমরা।’

গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত শনাক্ত হয়। এরপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ১৬ মার্চ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। এর ফলে পিছিয়ে যায় এইচএসসি পরীক্ষাও। ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকায় পিছিয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় দেখা দিচ্ছে সেশনজটের আশঙ্কা। শিক্ষা কার্যক্রম যাতে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন না হয় সে আশঙ্কা থেকে প্রথমে মাধ্যমিক স্কুলের জন্য সংসদ টিভিতে ক্লাস পরিচালনা শুরু করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর। এরপর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের উদ্যোগে শুরু হয় প্রাথমিকের ক্লাস। এক মাস ধরে চলছে এ শিক্ষা কার্যক্রম। জানা গেছে, দীর্ঘমেয়াদি সংকটের কথা মাথায় রেখেই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অনলাইনে ক্লাস পরিচালনার তাগাদা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল তিন সপ্তাহ আগে। তবে ইউজিসির আহ্বানের পরও অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় তার অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে পারছে না সফলভাবে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কোনোমতে জোড়াতালি দিয়ে কাজ চালাচ্ছে। আবার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে একটি বা দুটি বিভাগে সপ্তাহে একটি, দুটি ক্লাস নিচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অনলাইনে ক্লাস কার্যক্রম সফলভাবে চালিয়ে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি (বিডিইউ) এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এর বাইরে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অনলাইনে ক্লাস নিলেও নানা সীমাবদ্ধতার কারণে সফলভাবে তা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তুলনামূলকভাবে বড় প্রতিষ্ঠান, ডিজিটালাইজ না হওয়া এবং শিক্ষার্থীরা গ্রামের বাড়ি চলে যাওয়ায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ কাজে সফল হতে পারছে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চলমান সেমিস্টার গত এপ্রিলে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের সেমিস্টার কোর্স অনলাইনব্যবস্থায় পাঠদানের মাধ্যমে পাঠ্যক্রম সম্পন্ন করেছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এ সেমিস্টারের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। জানা গেছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের কীভাবে পরের সেমিস্টারে উত্তীর্ণ দেখানো যায় তা নিয়ে সম্প্রতি একটি ভার্চুয়াল বৈঠক করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, ইউজিসি চেয়ারম্যান ড. কাজী শহীদুল্লাহসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা এতে উপস্থিত ছিলেন। ইউজিসি চেয়ারম্যান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য শিগগিরই একটি নির্দেশনা জারি করবে ইউজিসি। এর আগে একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলা হয়েছিল, অনলাইনে শিক্ষার্থী ভর্তি ও অনলাইনে পরীক্ষা নিতে পারবে না বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। কিন্তু করোনাভাইরাস পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হওয়ায় সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আমরা দুটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি। একটি হচ্ছে- শিক্ষার্থীদের অনলাইনে ক্লাস টেস্ট, অ্যাসাইনমেন্ট, অনলাইন প্রেজেনটেশন, পূর্বের সেমিস্টারের ফলাফল সব মিলিয়ে একটি মূল্যায়ন করে পরের সেমিস্টারে উত্তীর্ণ করা যেতে পারে। আরেকটি হচ্ছে, বর্তমান সেমিস্টারের পরীক্ষাটি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে নেওয়া হবে। এর মধ্যে তারা পরবর্তী সেমিস্টারের কার্যক্রম ও অনলাইনে ক্লাস চালাতে পারবে। আগামী সপ্তাহে ইউজিসির পক্ষ থেকে এ নির্দেশনা জারি করা হবে। করোনা পরিস্থিতিতে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস চলছে। ইউজিসির কাছে প্রতিষ্ঠানগুলোর দেওয়া তথ্যানুসারে অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছে দেশের ৬৩টি বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে ৫৬টি বেসরকারি ও বাকি ৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে ক্লাস পরিচালনা করছে কিনা তা জানতে চেয়ে সম্প্রতি চিঠি দেয় ইউজিসি। ওই চিঠির পর দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ইউজিসিকে তাদের তথ্য জানায়। তবে কর্মকর্তারা বলছেন, ন্যূনতম কিছু কাজ ছাড়া সবাই দাবি করছে তারা সফলতার সঙ্গে কাজ করছে। কিন্তু বাস্তবে হাতে গোনা দু-একটি প্রতিষ্ঠানই মূলত এ কাজটি ভালোভাবে করতে পারছে। বাকি অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান নতুন শিক্ষাবর্ষে ভর্তির আশায় কোর্স শেষ হয়েছে বলে জানাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের অনলাইনে ও সংসদ বাংলাদেশ টেলিভিশনে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্ষমতা রয়েছে অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার। সামনে আমাদের জন্য কী পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে তা জানি না। তাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও অনলাইনে ক্লাস শুরু করতে হবে।

করোনার প্রভাবে শুধু শিক্ষার্থী নয় শিক্ষকরাও বিপাকে পড়েছেন। প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বেসরকারি নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা আর্থিক সংকটে পড়েছেন। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা নামমাত্র কিছু বেতন পেয়ে থাকেন। কোথাও কোথাও তাও পান না। বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের টিউশন ফিও বন্ধ। কারিগরি শিক্ষার প্রসারে দেশে বেসরকারি উদ্যোগে ৫৫৩টি বেসরকারি পলিটেকনিক গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠান শুধু শিক্ষার্থীদের বেতনের ওপর নির্ভরশীল। প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তাদের বেতন-ভাতার সংস্থান হচ্ছে না। এ ব্যাপারে স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান আলম সাজু বলেন, করোনারভাইরাস আরও দীর্ঘায়িত হলে পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল আকার ধারণ করবে। দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার প্রায় ৯৭ শতাংশ বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত হয়। শিক্ষা খাত বাঁচাতে সংশ্লিষ্ট স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রতিনিধি ও শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা যেতে পারে। সরকার ঘোষিত প্রণোদনার অংশ থেকে শিক্ষার জন্য একটি বিশেষ ফান্ড গঠন করা প্রয়োজন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর