সোমবার, ৪ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

যেভাবে করোনা জয় করলেন তারা

জিন্নাতুন নূর

যেভাবে করোনা জয় করলেন তারা

৬০ বছরের বৃদ্ধ থেকে শুরু করে ১০ মাসের শিশু, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, পুলিশ সদস্য ও পোশাকশ্রমিকসহ বিভিন্ন বয়সী ও শ্রেণি-পেশার মানুষ করোনাভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। এদের কেউ হাসপাতালের আইসোলেশন ইউনিটে থেকে, আবার কেউ বাড়িতে থেকে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলে সুস্থ হয়েছেন। আক্রান্তরা জানান, করোনা চিকিৎসার সময় চিকিৎসকের পরামর্শের সঙ্গে মনোবল শক্ত রাখাও বেশ জরুরি। আর এমনটি করা গেলেই করোনাভাইরাস জয় করা সম্ভব। মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার প্রথম করোনা শনাক্ত রোগী ও পুলিশ সদস্য মো. মহিদ্দীন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ, উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশের তাৎক্ষণিক সহযোগিতার মাধ্যমে হাসপাতালে ভর্তির পাশাপাশি মানসিক সহযোগিতা মহিদ্দীনের মনোবল বৃদ্ধি করে। হাসপাতালে চোখের সামনে অন্য করোনা আক্রান্ত রোগীর লাশের মিছিল দেখেও দৃঢ় মনোবল ছিল মহিদ্দীনের। এ ছাড়া সবার ভালোবাসায় ২০ দিন হাসপাতালে থাকার পর তিন দফা নমুনা পরীক্ষায় নেগেটিভ ফলাফল আসে এ পুলিশ সদস্যের। তিনি জানান, শরীরে ঠা া-জ¦র, কাশির উপসর্গ দেখা দিলে গত মাসের ৬ তারিখে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে কর্মস্থল গোপালগঞ্জ থেকে নিজের গ্রামের বাড়ি যান মহিদ্দীন। দুই দিনে শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হলে নিজেই ৮ তারিখে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মাধ্যমে শরীরের নমুনা ঢাকায় পাঠান। এর দুই দিন পর রিপোর্ট পজিটিভ আসে। ওই দিন রাতেই মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালের আইসোলেশনে রাখা হয় তাকে। পরে ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। মহিদ্দীন বলেন, ‘প্রতিদিনই কোনো না কোনো করোনা আক্রান্ত রোগী মারা যেত। তাদের লাশ চোখের সামনে দিয়ে নিয়ে যেত। চোখের সামনে স্ত্রী-পুত্রের স্মৃতি ভেসে উঠত। এর পরও মনোবল হারাইনি। সে সময় আমার শরীর প্রচ- দুর্বল ছিল। কয়েক দিন কিছুই খেতে পারতাম না। দিনে দুবার ডাক্তার এসে দেখে যেত। পরে শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়।’ ৩০ এপ্রিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মহিদ্দীনকে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। নীলফামারীর সৈয়দপুরে প্রথম কভিড-১৯ রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। সুস্থ হওয়া করোনা রোগীকে ২৯ এপ্রিল ফুলেল শুভেচ্ছার মাধ্যমে হাসপাতাল থেকে বিদায় জানানো হয় বলে জানান সিভিল সার্জন ডা. রণজিৎ কুমার বর্মণ। জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ-ফেরত যুবক হাফিজুল ইসলাম বিটুলের রক্ত পরীক্ষার পর করোনা পজিটিভ ফলাফল আসে। এরপর ৯ এপ্রিল তাকে সৈয়দপুর ১০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে আইসোলেশনে রাখা হয়। সেখানে দীর্ঘ ২১ দিন থাকার পর ২৯ এপ্রিল সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন হাফিজুল। ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত এক পরিবারের পাঁচ নারী চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়েছেন। ২ মে দুপুরে উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়ে সেই পাঁচ নারীকে আনুষ্ঠানিকভাবে করোনাজয়ী ঘোষণা করা হয়। জানা যায়, উপজেলার আঠারবাড়ী ইউনিয়নের উত্তর বনগাঁও গ্রামের মৃত আবুল কাশেমের দুই মেয়ে অজুফা আক্তার ও অনুফা আক্তার নারায়ণগঞ্জের পোশাক কারখানায় কাজ করেন। ৭ এপ্রিল কারখানা বন্ধ হওয়ার পর দুই বোন বাড়ি ফিরলে অজুফার শরীরে জ্বর দেখা দেয়। ১১ এপ্রিল ঈশ্বরগঞ্জ স্বাস্থ্য বিভাগের করোনা ইউনিট অজুফার নমুনা সংগ্রহ করে। ফল পজিটিভ এলে অজুফাকে ময়মনসিংহ এসকে হাসপাতালে আইসোলেশনে পাঠানো হয়। অজুফার পর তার পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীদের নমুনা সংগ্রহ করে স্বাস্থ্য বিভাগ। পরে ১৬ এপ্রিল ফলাফলে অজুফার দুই বোন, ফুফু ও চাচির শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা ডা. নুরুল হুদা খান বলেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর পরিবারটি তাদের তত্ত্বাবধানে থেকে নিয়ম মেনে চিকিৎসা নেন। এতে তারা সুস্থ হয়ে ওঠেন। আবার বাড়িতে চিকিৎসা নিয়েই করোনা জয় করেন রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম (২৬)। ১৩ এপ্রিল করোনা শনাক্ত হওয়ার পর থেকে তিনি বাড়িতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তৃতীয় দফায় ২৮ এপ্রিল তার নমুনা পরীক্ষার ফল নেগেটিভ পাওয়া যায়। জাহাঙ্গীর আলম রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার মাড়িয়া ইউনিয়নের যাত্রাগাছি গ্রামের বাসিন্দা। নারায়ণগঞ্জের একটি পোশাক কারখানায় টেক্সটাইল প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করেন তিনি। জাহাঙ্গীর বলেন, ‘পুরো সময়টাতেই মনোবল শক্ত রেখেছিলাম। করোনা জয় করতে পারব এমন আত্মবিশ্বাস ছিল। পরিবার কিছুটা দুশ্চিন্তায় ছিল। তাদেরও সাহস জুগিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ থেকে ৬ এপ্রিল রাজশাহী আসার পর থেকে স্বেচ্ছায় হোম কোয়ারেন্টাইনে ছিলাম। শরীরে জ্বর, কাশি ও হালকা শ্বাসকষ্ট অনুুভব করায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকের পরামর্শ নিই। ১১ এপ্রিল স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়িতে এসে চিকিৎসা দেওয়ার পাশাপাশি নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে যান। পরে ফল পজিটিভ আসে। চিকিৎসকের পরামর্শমতো কিছু ওষুধ সেবন করি। এ ছাড়া হালকা গরম পানিতে লবণ মিশিয়ে ঘন ঘন গরগরা করি। কিছুক্ষণ পর পর হালকা গরম পানি পান করি এবং নিয়মিত চা পান করি।’

করোনাভাইরাস থেকে সুস্থ হয়ে আবদুল বাসেত (২৯) নামে এক চিকিৎসক বাড়ি ফিরেছেন। তিনি ফটিকছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত অবস্থায় পজিটিভ হন। পয়লা মে তাকে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ড থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুই দফা নমুনা পরীক্ষা করে নেগেটিভ ফল আসে বাসেতের। ২২ এপ্রিল করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর আবদুল বাসেত হাসপাতালে ভর্তি হন। এ ছাড়া গাজীপুরে ঘরে চিকিৎসা নিয়ে ছেলেসহ এক সাংবাদিক করোনা জয় করেছেন। একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সাংবাদিক ইকবাল আহমদ ও তার ছেলে আবদুল্লাহ আল রাফির নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকায় পাঠানো হলে ১৪ এপ্রিল ফল পজিটিভ আসে। পরে নিজ বাড়িতে আইসোলেশনে থেকে চিকিৎসা শুরু হয় তাদের। ১৪ দিন চিকিৎসা শেষে তাদের নমুনা ঢাকায় পাঠানোর পর ফল নেগেটিভ আসে। বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার পুলিশ কনস্টেবল আহসান হাবীব করোনা জয় করেছেন। সুস্থ হওয়ার পর তাকে বগুড়া মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের আইসোলেশন ইউনিট থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। জানা যায়, ১৬ এপ্রিল রাত ৯টায় আহসান হাবীবকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। তিনি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে কর্মরত। জ্বর, সর্দি, কাশি নিয়ে ১২ এপ্রিল তিনি ঢাকা থেকে মোটরসাইকেল চালিয়ে তার গ্রামের বাড়ি যান। পর দিন ১৩ এপ্রিল স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীরা তার নমুনা সংগ্রহ করেন। ১৬ এপ্রিল তার ফল পজিটিভ আসে। টানা ১৪ দিন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে করোনাভাইরাসের চিকিৎসা নেওয়ার পর সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন রাজবাড়ী-১ আসনের এমপি ও সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী কাজী কেরামত আলীর স্ত্রী রেবেকা সুলতানা সাজু (৫২)। হাসপাতালে দীর্ঘদিনের চিকিৎসার সময় পাশে ছিলেন রেবেকার স্বামী কাজী কেরামত আলী। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অসুস্থ হয়ে পড়লে কাজী কেরামত আলী তার স্ত্রীকে ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে পরীক্ষা করান। তার করোনার ফল নেগটিভ আসে। চট্টগ্রামে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ১০ মাসের শিশু আবীর সুস্থ হলে তাকে ২ মে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। শিশুটি চন্দনাইশ উপজেলার পূর্ব জোয়ারা এলাকার বাসিন্দা। চিকিৎসা চলাকালে শিশুটির সঙ্গে তার মা হাসপাতালে ছিলেন। জেলা সিভিল সার্জন শেখ ফজলে রাব্বি জানান, সুস্থ হওয়ার পর শিশু আবীরকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তার নমুনা দুবার পরীক্ষায় করোনার ফল নেগেটিভ আসার পরই তাকে বাড়িতে চলে যাওয়ার ছাড়পত্র দেওয়া হয়। ২১ মার্চ রাতে করোনা শনাক্ত হওয়ার পর শিশু আবীরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে প্রথম শনাক্ত হওয়া করোনা রোগী ৬০ বছরের মো. মহিউদ্দীন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। ঢাকার কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা শেষে তিনি বাসায় ফেরেন। শ্রীনগর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সৈয়দ রেজাউল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেন। ১০ এপ্রিল তার নমুনা পরীক্ষায় করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব ধরা পড়ে। এ ছাড়া শেরপুরের শ্রীবরদীতে করোনা আক্রান্ত দ্বিতীয় শ্রেণির এক শিক্ষার্থী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে। সেই শিক্ষার্থীর নাম তৌহিদ। শনিবার বিকালে তৌহিদকে সুস্থতার ছাড়পত্র দেয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। তৌহিদ পৌর শহরের সাতানি মহল্লার বাসিন্দা। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আনোয়ার হোসেন জানান, তৌহিদ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আয়া ও জেলার প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী খোদেজা বেগমের নাতি। তৌহিদ ১০ দিন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আইসোলেশনে চিকিৎসাধীন ছিল। সব শেষ দুটি পরীক্ষায় তার কভিড-১৯ ফল নেগেটিভ আসে। পরে তাকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়।

সর্বশেষ খবর