সোমবার, ১১ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

রপ্তানি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে

সংকট মোকাবিলায় অ্যাকশন প্ল্যান করছে ইপিবি, থাকছে পৃথক প্রণোদনার সুপারিশ

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

এপ্রিল মাসে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৫৫ কোটি ডলারের, বিপরীতে এ মাসে রপ্তানি আয় হয়েছে মাত্র ৫২ কোটি ডলার। টাকার অঙ্কে যা সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। এটি গত বছরের একই মাসের তুলনায় প্রায় ৮৩ শতাংশ কম। অথচ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ চীন থেকে ইউরোপ-আমেরিকায় ছড়িয়ে যাওয়ার পরও গত মার্চে ২৭৩ কোটি ডলারের রপ্তানি আয় অর্জিত হয়েছিল। এখন এপ্রিলে সেটি কমে গত মার্চের মোট আয়ের ৫ ভাগের ১ ভাগে নেমে এসেছে প্রায়। রপ্তানি খাতে এই ভয়াবহ ধসে উদ্বেগ বাড়ছে সরকারের মধ্যে। আর সেই উদ্বেগ থেকে রপ্তানি শিল্পে বিরূপ প্রভাব নিরূপণে এবং তা কাটিয়ে ওঠার ‘অ্যাকশন প্ল্যান’ তৈরি করতে গতকাল একটি সভা করেছে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)।  সভায় উপস্থিত সূত্রগুলোর সঙ্গে কথা বলে যেসব সিদ্ধান্তের কথা জানা গেছে, সেগুলো হচ্ছে : (১) ছোট ছোট অপ্রাতিষ্ঠানিক রপ্তানি শিল্প যারা ব্যাংকিং খাতের বাইরে রয়েছে, তাদের জন্য সরকারের কাছে পৃথক প্রণোদনার সুপারিশ করা; (২) প্রাতিষ্ঠানিক (বড় ও মাঝারি) শিল্প খাতগুলোর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করে সরকারের কাছে নীতিগত সহায়তার প্রস্তাব করা; (৩) তৈরি পোশাক খাতের যেসব ক্রয়াদেশ বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ও ব্র্যান্ডগুলো, তাদের সেই সিদ্ধান্ত বদলাতে উদ্যোগ নেওয়া; (৪) করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে ব্যবহার্য ওষুধসামগ্রী ছাড়াও বিভিন্ন উপকরণ যেমন পিপিই, মাস্ক, স্যানিটাইজার, হ্যান্ড গ্লাভস ও ভেন্টিলেটর রপ্তানির বিষয়ে উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো; (৫) করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে বিশ্বব্যাপী যে নতুন ধরনের ফ্যাশনের চাহিদা তৈরি হচ্ছে- যেমন নকশা করা স্কার্ফ, নারী ও শিশুদের পোশাক তৈরিতে বাংলাদেশের সক্ষমতা আন্তর্জাতিক বিশ্বে তুলে ধরা; এবং (৬) চামড়া খাতকে সহায়তা করতে সাভারের চামড়াশিল্প নগরীর সুবিধা বাড়ানো। ইপিবির মহাপরিচালক-২ মাহবুবুর রহমানের নেতৃত্বে তৈরি হচ্ছে রপ্তানি খাতে সংকট মোকাবিলায় এই কর্মপরিকল্পনা। গতকালের সভায় সভাপতিত্বও করেছেন তিনি। সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতে চাইলে মাহবুবুর রহমান বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণে যেসব ছোট ছোট শিল্প খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যেমন লাইভ ফিশ (কাঁকড়া ও কুঁচে) রপ্তানি, হাড়গোড় ও নাড়িভুঁড়ি রপ্তানি- এগুলোর মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতগুলো, যারা ব্যাংকে ঋণ সুবিধা পায় না, তাদের জন্য পৃথক প্রণোদনার সুপারিশ করা হবে। আর মাঝারি ও বড় শিল্প খাত, যেগুলো প্রাতিষ্ঠানিক খাতে রয়েছে এবং যাদের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণের সক্ষমতা রয়েছে, তাদের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে সরকারের নীতিগত সুবিধা বাড়ানোর প্রস্তাব থাকবে কর্মপরিকল্পনায়। ইপিবির কর্মকর্তারা জানান, তৈরি পোশাকসহ প্রাতিষ্ঠানিক খাতের রপ্তানি শিল্পের জন্য এরই মধ্যে প্রণোদনা সুবিধা ঘোষণা করেছে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) পরিমাণও বাড়ানো হয়েছে। রপ্তানিমুখী শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের বেতন দিতে স্বল্প সুদে ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। তবে দেশে এমন আরও কিছু রপ্তানি খাত আছে, যারা করোনাভাইরাসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সরকার-ঘোষিত প্রণোদনা সুবিধার আওতায় আসবে না। তাদের সহায়তার আওতায় আনতেই কর্মপরিকল্পনায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের জন্য তৈরি করা ট্যারিফ কমিশনের এক প্রতিবেদনে দেশের ১৫টি রপ্তানি খাত চিহ্নিত করে তাতে প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির হিসাব দেওয়া হয়েছিল। ফেব্রুয়ারিতে তৈরি করা ওই প্রতিবেদনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত যেসব খাতের কথা উল্লেখ ছিল, সেগুলোর মধ্যে তৈরি পোশাক ছাড়াও কাঁচা চামড়া, ফিনিশড লেদার ও লেদারগুডস, গার্মেন্ট এক্সেসরিজ ও প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প, কাঁকড়া ও কুঁচে রপ্তানি (লাইভ অ্যান্ড চিল্ড ফুড), কাগজ, প্রকাশনা ও মুদ্রণশিল্প, প্লাস্টিক কসমেটিকস অ্যান্ড টয়লেট্রিজ, ইলেকট্রিক্যাল মার্চেন্ডাইজ ম্যানুফ্যাকচারার্স, জুট স্পিনার্স, মেডিকেল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যান্ড হসপিটাল ইকুইপমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স, চশমা, কম্পিউটার অ্যান্ড কম্পিউটার এক্সেসরিজ, ইলেকট্রনিক, হিমায়িত খাদ্য ও ভোগ্যপণ্যের নাম ছিল। ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান ও সিইও এ এইচ এম আহসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ট্যারিফ কমিশনের ওই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছিল সরবরাহ খাতের ওপর নির্ভর করে। তখন করোনাভাইরাসের প্রভাব সবচেয়ে বেশি ছিল চীনে। এর ফলে আমাদের রপ্তানি শিল্পের কাঁচামাল আমদানিজনিত সংকট তৈরি হয়েছিল। কিন্তু গত দুই মাসে ইউরোপ-আমেরিকায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এত তীব্র হয়েছে, যা বিশ্লেষকদের ধারণাকেও ছাড়িয়ে গেছে। এতে আমাদের রপ্তানিপণ্যের চাহিদা ব্যাপকভাবে কমে গেছে। এখন আমাদের ডিমান্ড ও সাপ্লাই উভয় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি নিয়েই ভাবতে হচ্ছে।’ এ অবস্থায় রপ্তানি খাতে যে উভয়মুখী সংকট তৈরি হয়েছে, সেটি চিহ্নিত করে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প খাতগুলোকে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি উভয় ধরনের সুবিধা আনার প্রস্তাবনা ও সুপারিশ তারা মন্ত্রণালয়ে পাঠাবেন বলে জানান।

সর্বশেষ খবর