সোমবার, ১১ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

বাড়ছে সামাজিক সংকট

ঘরে ঘরে পারিবারিক কলহ মানসিক অস্থিরতায় ভুগছে শিশু

জিন্নাতুন নূর

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে প্রায় দেড় মাস ধরে বাংলাদেশে চলছে লকডাউন। আর দীর্ঘ সময় ঘরবন্দী থাকায় ঘরে ঘরে বেড়েছে দাম্পত্য কলহ ও পারিবারিক অশান্তি। খেলাধূলা ও বন্ধু-বান্ধবহীন শিশুর মানসিক অস্থিরতাও তৈরি হচ্ছে। নির্মমতা থেকে বাদ যাচ্ছে না বয়স্করাও। প্রতিকূল এ সময়ে বৃদ্ধ মাকে জঙ্গলে ফেলে পালিয়ে যাচ্ছে সন্তানরা। পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা লকডাউন নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত থাকায় বাড়ছে ধর্ষণের মতো অপরাধ। সব মিলিয়ে করোনা সংক্রমণের কারণে বিশ্বের অন্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও বাড়ছে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সংকট। বিশেষজ্ঞরা এ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে শিশুদের ওপর বিশাল মনস্তাত্ত্বিক চাপ পড়বে। আর লকডাউন শেষে পারিবারিক কলহ-সংক্রান্ত মামলা-মোকদ্দমার সংখ্যাও বিশাল আকার ধারণ করবে। বেসরকারি একটি এনজিওর কর্মকর্তা সাইফুল হাসান জানান, লকডাউনের দীর্ঘ সময়ে ঘরে অবস্থান করার কারণে প্রায়ই তার স্ত্রীর সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়। গৃহকর্মীকে          ছুটি দেওয়ায় ঘরের সব কাজসহ দুই বাচ্চাকে সামাল দিতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছেন সাইফুলের স্ত্রী সামিরা। কিছু দিন ধরে মায়ের বাড়ি চলে যাওয়ার ভয় দেখালেও এ মাসের শুরুতে সত্যি সত্যি বাচ্চাদের নিয়ে মায়ের বাড়ি চলে যান সাইফুলের স্ত্রী। সাইফুল এরই মধ্যে সামিরাকে বিচ্ছেদ দেবেন বলে মৌখিকভাবে জানিয়েছেন। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, লকডাউনের কারণে বর্তমানে মোবাইলেই সেবাপ্রত্যাশীদের কাউন্সিলিং দিচ্ছি। অনেক ভুক্তভোগী আমার কাছে ফোন করে তাদের ওপর হওয়া নির্যাতনের ব্যাপারে আইনি পরামর্শ নিচ্ছেন। স্বামী-স্ত্রী দীর্ঘদিন ধরে ঘরে অবস্থান করায় পারিবারিক কলহ স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বেড়েছে। বিশেষ করে আদালত বন্ধ থাকায় এবং পুলিশ প্রশাসন করোনা পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যস্ত থাকায় এ ধরনের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ জন্য স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। নারীদের ওপর আগের চেয়ে গৃহস্থালি কাজের চাপ বেড়ে যাওয়ায় পুরুষদেরও গৃহস্থালি কাজে সহযোগিতা করতে হবে। অন্যদিকে বিনোদন ছাড়া ঘরবন্দী অবস্থায় মা-বাবার সহিংসতা দেখে শিশুদের ওপর মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা সংক্রমণে একদিকে মানসিক যন্ত্রণা, অন্যদিকে চাকরি হারানো এবং কাজ না থাকায় অর্থনৈতিক স্থবিরতায় মানুষের জীবনে বিশাল প্রভাব পড়ছে। শিশুরা মানসিক বিকারগ্রস্তভাবে বড় হচ্ছে। আবার স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে এ সময় বিবাহ বিচ্ছেদের হারও বেশি হচ্ছে বলে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিটি পরিবারে শিশুদের বিনোদনমূলক পরিবেশ নিশ্চিত করতে অন্য সদস্যদেরও এগিয়ে আসতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনা সংক্রমণের সময়ে হওয়া পারিবারিক সহিংসতাকে সাধারণ সহিংসতার মতো মনে করা যাবে না। কোনো পরিবারে সহিংসতার ঘটনা ঘটলে সে ক্ষেত্রে পরিবারের সমঝদার ব্যক্তিকে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে। কিন্তু এ পরিস্থিতি যদি দীর্ঘদিন চলে তাহলে বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার। গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল থেকে এ ব্যাপারে করণীয় সম্পর্কে মানুষকে উপদেশ দেওয়া সহজ হবে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সম্প্রতি জাতীয় জরুরি হেল্পলাইন ও বিভিন্ন এনজিওতে পারিবারিক সহিংসতার অভিযোগ জানিয়ে ভুক্তভোগীদের কলের সংখ্যাও বেড়ে গেছে। ভুক্তভোগী অনেক নারী ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য আত্মীয়স্বজনসহ পরিচিতদের সহযোগিতা চাইছেন। ভালো নেই শিশুরাও। স্কুল বন্ধ এবং করোনা সংক্রমণের ভয়ে ঘরবন্দী থাকায় দেশের কোটি কোটি শিশু মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। ঘরের ভিতর তারা টিভি দেখে ও ভিডিও গেম খেলেই সময় পার করছে। একটানা দীর্ঘদিন ঘরে থেকে অনেক শিশু মা-বাবার কাছে ছাদে যাওয়ার আবদার করছে। যারা পারছে না তারা উদাস মনে ঘরের বারান্দাতেই দাঁড়িয়ে থাকছে।  শিশুদের এ মানসিক অস্থিরতায় উদ্বিগ্ন অভিভাবকরাও।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর