মঙ্গলবার, ১২ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

অসহায় সাধারণ রোগীরা

রোগী নিয়ে সাতটি হাসপাতাল ঘুরেও চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারছেন না স্বজনরা। করোনা নেগেটিভ সনদ নিয়ে গেলেও মিলছে না সেবা

নিজস্ব প্রতিবেদক

করোনা মহামারীতে বিভীষিকায় পড়েছে মুমূর্ষু রোগীরা। প্রাণ যায় যায় অবস্থা হলেও রোগীর কাছে আসছেন না চিকিৎসক, ফিরিয়ে দিচ্ছে হাসপাতাল। প্রতিদিন দীর্ঘ হচ্ছে বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়া রোগীর সারি। রোগী নিয়ে সাতটি হাসপাতালে ঘুরেও চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারছেন না স্বজনরা। করোনা নেগেটিভ সনদ নিয়ে গেলেও মিলছে না সেবা। গত ২১ সেপ্টেম্বর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান রাসেল। সর্বশেষ গ্রিন লাইফ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় গত ১০ এপ্রিল হাসপাতাল থেকে তাকে বাসায় নিয়ে যেতে বলেন চিকিৎসকরা। ৫ মে মধ্যরাতে মাহবুবুর রহমান রাসেলের গলায় লাগানো কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস সরবরাহের নল খুলে যায়। এতে শ্বাসকষ্ট শুরু হয় তার। পাঁচটি হাসপাতালে এই সংকটাপন্ন রোগীকে নিয়ে গিয়েছিলেন স্বজনরা কিন্তু কেউ ন্যূনতম সেবাটুকু দেয়নি। রোগীর আগের অসুস্থতার বিষয়ে বর্ণনা করলেও এগিয়ে আসেনি কেউ। স্বজনদের চোখের সামনে ধীরে ধীরে থেমে যায় তার হৃদস্পন্দন। মাহবুবুর রহমান রাসেলের ভাগ্নে সোহেল মোহাম্মদ নাফি বলেন, ‘১০ এপ্রিল রাজধানীর গ্রিন লাইফ হাসপাতাল থেকে মামাকে বাসায় নিয়ে আসা হয়। করোনার কারণে চিকিৎসকরা বাসায় নিয়ে যেতে বলেন। ৫ মে মাঝ রাতে মামার গলায় লাগানো ট্রাকিওস্টমি (কৃত্রিমভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস সরবরাহের) এর নলটা খুলে গিয়েছিল। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল তার। আমরা তাকে প্রথমে গ্রিন লাইফ হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিন্তু তারা করোনার সনদ ছাড়া চিকিৎসা দেবে না বলে জানিয়ে দেয়। এরপর ল্যাবএইডে গেলে কর্তৃপক্ষ জানায়, তাদের আইসিইউ লকডাউন। স্কয়ারে গেলে তারাও ফিরিয়ে দেয়। নিউ লাইফ হাসপাতালে গেলে তারা জানায় নাক, কান, গলার চিকিৎসক নাই। সবেশেষে ঢাকা মেডিকেলে যাই। সেখানেও মামাকে গাড়িতে রেখে ডাক্তারের জন্য ছোটাছুটি করি। কিন্তু কেউ আসেনি। অবশেষে সেখানেই মামা মারা যান।’ এই ভোগান্তি শুধু একজনের না দেশের অধিকাংশ হাসপাতালেই জরুরি সেবা পাচ্ছে না রোগীরা। করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়েছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে। এ ভাইরাসের উপসর্গের সঙ্গে মিল না থাকলেও রোগী ভর্তি অথবা চিকিৎসা সেবা দিতে অনীহা প্রকাশ করছেন চিকিৎসক, নার্স এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অন্য কোনো রোগের চিকিৎসা করাতে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন সাধারণ রোগীরা। হৃদরোগ কিংবা কিডনি রোগে ভুগলেও মিলছে না চিকিৎসা। এমন পরিস্থিতিতে অনেক রোগী এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছোটাছুটি করতেই প্রাণ হারাচ্ছেন। একের পর এক হাসপাতাল ঘুরে কিডনি জটিলতায় মারা গিয়েছেন অতিরিক্ত সচিব গৌতম আইচ সরকার। রাজধানীর ল্যাবএইড, স্কয়ার, ইউনাইটেড, সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, রিজেন্ট হাসপাতাল, আনোয়ার খান মডার্নসহ রাজধানীর আরও কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরেও বাবার চিকিৎসা করাতে পারেননি মেয়ে ডা. সুস্মিতা আইচ। অন্য কোনো হাসপাতাল না পেয়ে শেষে গত বৃহস্পতিবার করোনা রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল এই সরকারি কর্মকর্তাকে। গত শনিবার তিনি মারা যান। ডা. সুস্মিতা আইচ বলেন, ‘করোনার উপসর্গ না থাকলেও কোনো উপায় না পেয়ে অনেক কষ্টে বাবাকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করাই। বাবার আইসিইউ সহায়তা খুব দরকার ছিল, কিন্তু তা পাওয়া যায়নি। বাবার চিকিৎসাই হলো না, তিনি মারা গেলেন। আমি ডাক্তার হয়েও কিছু করতে পারলাম না।’ যে ৩৩৩ হটলাইন নম্বর থেকে সরকার স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে, সেখানে দায়িত্ব পালন করছেন ডা. সুস্মিতা। একইভাবে চিকিৎসার অভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনেই মারা গেছেন ভোরের কাগজের ক্রাইম রিপোর্টার আসলাম রহমান। ওই সময় সঙ্গে থাকা আসলাম রহমানের সহকর্মী ইমরান জানান, ‘গত বৃহস্পতিবার রাতে তীব্র শ্বাসকষ্ট দেখা দেওয়ায় আসলামকে শান্তিবাগের বাসা থেকে জরুরি ভিত্তিতে প্রথমে কাকরাইলের ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) নিয়ে যেতে বলেন। ঢামেকের জরুরি বিভাগে গিয়ে রোগীর সমস্যার কথা জানালেও কেউ এগিয়ে আসেননি। তার করোনা টেস্ট নেগেটিভ এ কথা জানানোর পরেও কেউ সেবা দিতে প্রস্তুত ছিলেন না। এভাবে হাসপাতালের সামনে গাড়িতেই নিস্তেজ হয়ে পড়েন আসলাম রহমান। পরে ঢামেকের করোনা ইউনিটে ইসিজি করে দেখা যায় তিনি আর বেঁচে নেই।’ ভাইরাস বিশেষজ্ঞ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ডা. নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জরুরি রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া আবশ্যক। প্রয়োজনে হাসপাতাল থেকে রোগী ও তার স্বজনদের টেস্ট করানোর জন্য রেফারেন্স দেওয়া যেতে পারে। নইলে এমন রোগী নিয়ে স্বজনরা টেস্টের জন্য কোথায় দৌড়ঝাঁপ করবেন? স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এ বিষয়ে চিন্তা করা জরুরি।’

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর