শনিবার, ১৬ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনায় ১৪৯ লাশ দাফন করল কোয়ান্টাম

শিমুল মাহমুদ

করোনায় ১৪৯ লাশ দাফন করল কোয়ান্টাম

করোনায় মৃত একজনের লাশ দাফন করছেন কোয়ান্টামের স্বেচ্ছাসেবী কর্মীরা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

করোনাভাইরাস আক্রান্ত বাবাকে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে রেখে গেছেন ছেলে। বলে গেছেন, মারা গেলে ফোনে জানাবেন। ১৩ মে মৃত্যুর পর পরিবার থেকে তেমন সাড়া পায়নি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। খবর দেওয়া হয় কোয়ান্টামে। স্বেচ্ছাসেবীরা গিয়ে লাশ গ্রহণ, জীবাণুমুক্তকরণ, গোসল, কাফন সেরে দাফনের প্রস্তুতি নিতেই মধ্যরাত। ততক্ষণে মৃতের কন্যার ফোন, লাশের প্যাকেটটা যেন একটি নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া হয়। এর আগেই এই লাশের আনুষ্ঠানিকতায় ছয় ঘণ্টা কেটে গেছে স্বেচ্ছাসেবীদের। একই হাসপাতালে করোনায় মৃত দেশের প্রথম ব্যাংকারের লাশ নিতেও কেউ আসেনি। দাফনের পর তার ব্যাগ, ব্রিফকেস, লাগেজ নিতে আসেন স্বজনরা। ঢাকা মেডিকেলে মৃত এক মহিলার স্বজনরাও লাশ নিতে আসেননি। তার পরণে ছিল স্বর্ণালঙ্কার। সেগুলো খুলে দিতে পাঠানো হয় এক অচেনা লোককে, যিনি মহিলার লাশ শনাক্ত করতে পারেন না। পরে স্বজনদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে পরনের কাপড়ের বর্ণনা অনুযায়ী শনাক্ত করে অলঙ্কার খুলে দেওয়া হয়। একই হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত মা সন্তান জন্ম দিয়েই মারা যান। সদ্যমৃত স্ত্রীকে ফেলে নবজাতক সন্তানকে নিয়ে পালিয়ে যান বাবা। করোনায় মৃত্যুর পর হঠাৎ বেওয়ারিশ হয়ে যাওয়া এসব মানুষের লাশ দাফন নিয়ে অসংখ্য অমানবিক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবীরা। তারা গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত সারা দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমিত এবং সন্দেহভাজন ১৪৯ জনের মৃতদেহ দাফন ও সৎকার করেছেন।

কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের দাফন কার্যক্রমের সমন্বয়ক সালেহ আহমেদ জানান, ফাউন্ডেশনের নিবেদিত ও প্রশিক্ষিত ১৮০ জন স্বেচ্ছাসেবী ঢাকা ছাড়াও দেশের ১৮টি জেলা থেকে সারা দেশে করোনায় মৃত লাশের দাফন কার্যক্রম চালাচ্ছে। তিনি বলেন, দুই দশক ধরে আমরা অন্যান্য মানবিক সেবা কার্যক্রমের পাশাপাশি দাফন কার্যক্রম পরিচালনা করছি। শত শত লাশ দাফনের অভিজ্ঞতা রয়েছে আমাদের স্বেচ্ছাসেবীদের। কিন্তু এবারের দাফনের অভিজ্ঞতা অত্যন্ত হৃদয়বিদারক, অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি জানান, দাফনকালে স্বেচ্ছাসেবকদের ১৩ রকমের এবং লাশের জন্য ২৭ রকমের সুরক্ষা সামগ্রী প্রয়োজন হয়। করোনায় মৃত মহিলা এবং সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দাফনের জন্য আলাদা টিম রয়েছে কোয়ান্টামের। দাফন ও সৎকার কাজের পুরো প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত পিপিই, মাস্ক, সেফটি গ্লাস, ফেস শিল্ড, সার্জিক্যাল হ্যান্ড গ্লাভস, হেভি গ্লাভস, নেক কভার ও মরদেহের কাফনের কাপড় সবকিছুই কোয়ান্টামের নিজস্ব অর্থায়নে সংগ্রহ করা হয়। মরদেহ বহনের জন্য বিশেষ বডি ব্যাগসহ সুরক্ষার জন্য তিন ধরনের জীবাণুনাশক ব্যবহার করা হয়। প্রতিটি মরদেহ সৎকারের পর সুরক্ষার জন্য পিপিইসহ পরিধেয় অন্যান্য সামগ্রী কবরস্থানেই পুড়িয়ে ফেলা হয়। করোনায় মৃতদের দাফনে সুরক্ষা উপকরণ সংগ্রহসহ পুরো প্রক্রিয়াটিই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিত মান অনুযায়ী সম্পন্ন করা হয়। এতে প্রতিটি দাফনে কমবেশি ১০ হাজার টাকা খরচ পড়ে। গতকাল পর্যন্ত ১৪৯ জনের মধ্যে ঢাকায় ১২৯ জনের এবং ঢাকার বাইরে ২০ জনের দাফন সম্পন্ন করেছে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন। রাজধানীর কাকরাইলে কোয়ান্টাম দাফন কার্যক্রমের একটি ডেডিকেটেড অফিস থেকে তদারকি করা হচ্ছে সারা দেশের দাফন কার্যক্রম। গত ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে নিজের ঘর, সংসার, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ৫০ জনের একটি টিম ২৪ ঘণ্টা কাজ করছে করোনায় মৃত লাশ দাফনে। ঢাকায় ট্রেনিং করা ১০২ জনের বাকি সদস্যরাও প্রয়োজনে যোগ দেন তাদের সঙ্গে। ১৪৯ জনের দাফন করলেও যথাযথ নিরাপত্তা প্রস্তুতির কারণে এখন পর্যন্ত স্বেচ্ছাসেবীরা সবাই সুস্থ ও সুরক্ষিত আছেন। সালেহ আহমেদ বলেন, আমরা করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত দেশের তিনজন বীর মুক্তিযোদ্ধার দাফন করতে পেরেছি। তার মধ্যে পুরান ঢাকার একজন মুক্তিযোদ্ধা বাসায় মারা যান। তাকে ঢাকা মহানগর হাসপাতালে নেওয়া হয়। জনপ্রিয় সেই মুক্তিযোদ্ধার লাশ নিয়ে মধ্যরাতে খিলগাঁওয়ে দাফন করি আমরা। শুধু তার ছেলে ছিলেন আমাদের সঙ্গে। আক্ষেপ করে তিনি বললেন, বাবার এত স্বজন-শুভাকাক্সক্ষী মৃত্যুর সময় কাউকে পেলাম না। দাফন কার্যক্রমের পুরো ব্যয়ভারই বহন করছেন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সদস্য ও শুভাকাক্সক্ষীরা। চাইলে যে কেউ এই মানবিক উদ্যোগের অংশীদার হতে পারেন। এ ব্যাপারে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের দাফন কার্যক্রমের সমন্বয়ক সালেহ আহমেদের সঙ্গে ০১৩০৬৪১৩১৬৩ নম্বরে এবং ওয়েবসাইট : quantummethod.org.bd ঠিকানায় গিয়ে আপনার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারেন।

সর্বশেষ খবর