সোমবার, ১৮ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

টেস্টের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ লড়াই

নিজস্ব প্রতিবেদক

টেস্টের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ লড়াই

করোনাভাইরাসের টেস্ট করানোর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ লড়াইয়ে নামতে হচ্ছে নাগরিকদের। নমুনা পরীক্ষার সিরিয়াল পাওয়ার জন্য রাতেই লাইনে দাঁড়াতে হয়। অনেকেই রাতভর কাগজ বা চাদর বিছিয়ে শুয়ে থাকছেন ফুটপাথে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের করোনা টেস্টিং সেন্টারে দেখা গেছে মানুষের উপচে পড়া ভিড়। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ও বারডেম হাসপাতালের মাঝে অবস্থিত এই টেস্টিং সেন্টারে করোনা পরীক্ষার লাইন হলেও সেখানে নেই কোনো সামাজিক দূরত্ব। অনেকে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ব্যবস্থাও নেননি ঠিকমতো। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে তারা দাঁড়িয়ে আছেন ভিতরে যাওয়ার অপেক্ষায়।

করোনাভাইরাসের টেস্ট করতে গিয়ে ভোগান্তি যেন শেষই হচ্ছে না। চাইলেও করানো যাচ্ছে না টেস্ট। ঘুরতে হচ্ছে দিনের পর দিন। অনেক ক্ষেত্রে ঘুরতে ঘুরতে রোগীর মৃত্যু হলেও টেস্ট হচ্ছে না। মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ১২ দিন ঘুরেও নমুনা পরীক্ষা করাতে পারেননি অনেকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে টেস্ট ও টেস্টের কথা বলা হলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এর ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে। যেখানে টেস্ট করা হচ্ছে সেখানকার পরিবেশ নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। কোথাও গাদাগাদি করে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আবার কোথাও একই ঘরের মধ্যে নমুনা পরীক্ষা করতে যাওয়া সবাইকে বসিয়ে রাখা হচ্ছে। সেখানেই গায়ে গা লাগিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে সম্ভাব্য পজিটিভ ও নেগেটিভ রোগীকে। আবার করোনা টেস্ট ছাড়া সাধারণ কোনো রোগীকেও ভর্তি করা হচ্ছে না হাসপাতালগুলোতে। টেস্টের এই দীর্ঘ ভোগান্তি শেষ করতে করতে রোগীই বিদায় নিচ্ছে পৃথিবী থেকে।

গত ৩ মে আবদুর রাজ্জাক নামে একজন দুই ছেলেকে সঙ্গী করে ফুসফুসে ব্যথা নিয়ে করোনাভাইরাসের (কভিড-১৯) সংক্রমণ পরীক্ষার জন্য এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) করোনা টেস্ট শাখায়। প্রায় তিন ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর দুপুরের দিকে জানানো হয়, ওই দিনের মতো করোনা টেস্টের নমুনা গ্রহণ শেষ, পরদিন আবার নেওয়া হবে। এ কথা শোনার কিছু সময় পর জ্যেষ্ঠ নাগরিক আবদুর রাজ্জাক মাথা ঘুরে পড়ে যান। সঙ্গে থাকা ছেলেদের আর্তচিৎকারে আশপাশের মানুষ ছুটে আসেন। কিন্তু ততক্ষণে আবদুর রাজ্জাকের প্রাণপ্রদীপ নিভে গেছে। মোহাম্মদপুরের এই বাসিন্দার ছেলেরা জানান, শরীরে করোনা উপসর্গ ছিল মূলত ফুসফুসে ব্যথা। হয়তো বাবা স্ট্রোক করে মারা যেতে পারেন। জানা যায়, গত ২৩ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক উপদেষ্টা খন্দকার মিল্লাতুল ইসলাম তিন দিন ধরে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) ঘুরেও করোনা টেস্ট করাতে পারেননি। এমনকি মৃত্যুর পরও এই কর্মকর্তার নমুনা নিতে আসেনি আইইডিসিআরের কেউ। সংশ্লিষ্ট কারও কোনো ভ্রƒক্ষেপ না দেখে তাই দাফনের আগে নিজেরাই নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। মহানগর জেনারেল হাসপাতাল থেকে চিকিৎসক এনে দাফনের পূর্ব মুহূর্তে আনা হয় নমুনা। পরে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। পরীক্ষায় ধরা পড়ে খন্দকার মিল্লাতুল ইসলাম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন। খন্দকার মিল্লাতুল ইসলামের ছেলে খন্দকার মাজহারুল ইসলাম শাওন নিজেও একজন চিকিৎসক। শাওন বলেন, ‘মৃত্যুর ঠিক দুই দিন আগে বাবার শরীরে জ্বর হয়। এরপর আমরা আইইডিসিআরের হটলাইনে বারবার ফোন করেছি, কিন্তু কোনো সাড়া পাইনি। সর্বশেষ আমি নিজেও আইইডিসিআরে গিয়েছি। তারপরও কোনো সাহায্য পাইনি। তারা বলেছে এখানে কোনো টেস্ট হয় না। অফিস বন্ধ। সেখান থেকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে গিয়েছি। তারা বলেছে, আমরা করোনা টেস্ট ছাড়া রোগী ভর্তি নেব না। তাদের বলেছি অন্তত টেস্টটা করতে। তারা করেনি। সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়েছি বাবাকে। তখন ডাক্তার জানিয়েছেন বাবা আর নেই। সব জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে শেষ হয়েছি। নিজে ডাক্তার হয়েও কারও একটু সাহায্য পাইনি।’ খন্দকার মিল্লাতুল ইসলামের মতো আরও অনেকেই আছেন, যারা করোনা শনাক্তের টেস্ট করাতে চেষ্টা করেও হটলাইনে সংযোগ পাননি। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও সরাসরি আইইডিসিআরের কার্যালয়ে গেলেও তাদের কোনো লাভ হয়নি। আবার যারা যোগাযোগ করতে পেরেছেন এবং টেস্ট করানোর জন্য আইইডিসিআরের তালিকাভুক্ত হয়েছেন তাদেরও কেউ কেউ ভোগান্তিতে পড়েছেন। প্রথমত, টেস্ট করানোর জন্য তদবির করতে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, তালিকাভুক্ত হয়েও অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে দিনের পর দিন। মিরপুরের তানজিনা জানান, আমার লক্ষণ শুনে আইইডিসিআর থেকে বলা হয়, আমার করোনা টেস্ট করা হবে। দ্রুত লোক পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু সেদিন টেস্টের জন্য কোনো লোক আসেনি। পরদিনও আসেনি। ফোন করলে বলে দ্রুত পাঠাচ্ছে। এভাবে তিন দিন চলে যায়। এদিকে আমার শ্বাসকষ্ট বাড়ছিল। অবস্থা দেখে আমার পরিচিত কয়েকজন তদবিরের চেষ্টা করেন। শেষ পর্যন্ত চতুর্থ দিনের মাথায় এসে স্যাম্পল নিয়ে যায় আইইডিসিআরের লোক।

গাদাগাদি করে দাঁড় করিয়ে নেওয়া হচ্ছে নমুনা : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের করোনা টেস্টিং সেন্টারে দেখা গেছে মানুষের উপচে পড়া ভিড়। সাবেক হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ও বারডেম হাসপাতালের মাঝে অবস্থিত এই টেস্টিং সেন্টারে করোনা পরীক্ষার লাইন হলেও সেখানে নেই কোনো সামাজিক দূরত্ব। অনেকে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ব্যবস্থাও নেননি ঠিকমতো। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে তারা দাঁড়িয়ে আছেন ভিতরে যাওয়ার অপেক্ষায়। একদিকে পুলিশ, মাঝখানে ডাক্তার-নার্স ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং আরেক পাশে সাধারণ মানুষের লাইন। সকাল ৮টার আগে থেকে শুরু হওয়া এই লাইনে অপেক্ষা করতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কেউ কেউ দীর্ঘ লাইন দেখে ফিরেও যাচ্ছেন। ভিতরে গিয়েও নমুনা দেওয়ার জন্য আবার লাইনে দাঁড়াতে হয়।

একই কক্ষে ঘেঁষাঘেঁষি করে বসিয়ে রাখা হচ্ছে : ঢাকা মেডিকেল কলেজে করোনাভাইরাস নমুনা সংগ্রহের জন্য একটি কক্ষে দীর্ঘক্ষণ ধরে গায়ে গা ঘেঁষে বসিয়ে রাখা হচ্ছে নমুনা দিতে আসা ব্যক্তিদের। এখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হচ্ছে সম্ভাব্য পজিটিভ নেগেটিভ সবাইকে।

সর্বশেষ খবর