শিরোনাম
মঙ্গলবার, ১৯ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনায়ও থেমে নেই ওরা

আগের গতিতেই ঘটছে অপরাধ, পরিস্থিতিতে পাল্টেছে কৌশলও

সাখাওয়াত কাওসার

ঘটনা-১: গত ১০ মে ডাচ বাংলা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ৫৫ লাখ টাকা জমা দিতে যাত্রাবাড়ী থেকে মোটর সাইকেলে করে মতিঝিল যাচ্ছিলেন দুই ভাই সাইফুল ইসলাম সবুজ (৩৫) ও রফিকুল ইসলাম মুকুল (৩০)। বেলা ১১টার দিকে সায়েদাবাদ জনপথ মোড়ে পৌঁছামাত্র তিনটি মোটরসাইকেলে আসা ছয় ছিনতাইকারী তাদের গতিরোধ করে। দুই সহোদরকে রড দিয়ে পিটিয়ে ফাঁকা গুলি করে ৫৫ লাখ টাকা ছিনতাই করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। সাত দিন পেরিয়ে গেলেও ছিনতাইকারীদের গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
ঘটনা-২: গত বুধবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে গোড়ান ঝিলপাড় এলাকায় আবুল বাশার তালুকদার নামের এক ঠিকাদারকে নৃশংসভাবে খুন করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় বাদী হয়ে নিহতের ভাই উজ্জ্বল খিলগাঁও থানায় একটি মামলা করেন। হত্যাকা-ের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই শফিক নামের এক হোতাকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। ঘটনা-৩: গত ২৩ এপ্রিল গাজীপুরের শ্রীপুরে চাঞ্চল্যকর চার খুনের ঘটনায় হতচকিত হয়ে পড়েন খোদ আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যসহ এলাকাবাসী। ভয়ঙ্কর ওই দুর্বৃত্তরা খুনের আগে মা ও তার দুই মেয়েকে ধর্ষণ করে। মেয়েদের একজন সাত বছরের শিশুও ছিল। দুর্বৃত্তদের নৃশংসতা থেকে বাদ পড়েনি ৫ বছরের প্রতিবন্ধী ছেলেও। এতো গেল মাত্র কয়েকটি ঘটনা। প্রাণঘাতী অদৃশ্য ভাইরাস কভিড ১৯-এ যখন পর্যুদস্ত গোটা বিশ্বের মানুষ। আতঙ্ক আর উদ্বেগে যখন কাটছে সব শ্রেণির মানুষের প্রতিটি মুহূর্তÑ তখনো থেমে নেই অপরাধীরা। অনেকটা আগের গতিতেই চলছে হত্যা, ধর্ষণ, ডাকাতি, ছিনতাই, মাদক চোরাচালান, সাইবাসহ বহুমাত্রিক সব অপরাধ। অনেক অপরাধী আবার চলমান এ সময়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তুলনামূলক ঢিলেঢালা আচরণকে সুযোগ হিসেবে বেছে নিয়েছে। গত ১ এপ্রিল মোহাম্মদপুর এলাকার কলেজগেটের বিল্লাহ ফার্মেসি, ৫ এপ্রিল একই কায়দায় খিলগাঁওয়ের লাজফার্মায় ডাকাতির ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে একটি চক্রের ৫ সদস্যকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে তারা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে, এই করোনার সময়েই ১০০টির বেশি ছিনতাই-ডাকাতি করে ফেলেছে। করোনাকেই তারা মোক্ষম সময় হিসেবে বেছে নিয়েছিল। অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, অপরাধ কখনো বন্ধ থাকে না। চলমান সময়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ভূমিকায় মানুষ ভূয়সী প্রশংসা করছে। লকডাউন বাস্তবায়নের কারণে অপরাধীদের উপর নজরদারি কিংবা অপরাধ ব্যবস্থাপনার উপর র‌্যাব-পুলিশ আগের মতো সময় দিতে পারছে না বলে আমার মনে হচ্ছে। তবে তাদের উচিত হবে দক্ষ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে অপরাধ ব্যবস্থাপনার উপর বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া। চলমান মহামারীর সময়েই সম্প্রতি কক্সবাজারের টেকনাফে বিজিবি দেড় কোটি টাকার ইয়াবার চালান উদ্ধার করে। পরবর্তীতে এক মাদক ব্যবসায়ী পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়। র‌্যাব-২ এর কোম্পানি কমান্ডার পুলিশ সুপার মহিউদ্দীন ফারুকীর নেতৃত্বে একটি দল গত ৪ মার্চ রাজধানীর বসিলা এলাকায় একটি পিকনিকের বাস থেকে ২০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধারসহ চারজনকে গ্রেফতার করে। পরবর্তীতে গত ১৬ এপ্রিল জয়পুরহাট থেকে আসা একটি পিকআপ থেকে ১০০০ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধারসহ তিনজনকে গ্রেফতার করে। অনেকটা একই কায়দায় কুমিল্লা থেকে আসা ৬০০ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধারসহ একজনকে গ্রেফতার করে ওই টিম। সর্বশেষ গত ২৯ এপ্রিল মোহাম্মদপুর টাউন হলের সামনে থেকে আলু ভর্তি একটি পিকআপের পাটাতনে বিশেষভাবে নির্মিত বক্স থেকে ৫০০ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধারসহ ৫ জনকে গ্রেফতার করে। র‌্যাব-১ এর কোম্পানি কমান্ডার মেজর আবদুল্লাহ আল মেহেদীর নেতৃত্বে একটি দল গত ৬ মে নারায়ণগঞ্জ রূপগঞ্জ থানাধীন কাঞ্চন পৌরসভার পশ্চিম কালাদী এলাকা থেকে পুলিশ লেখা স্টিকার লাগিয়ে মাদক চোরাচালানের সময় একটি গাড়িসহ ৪০ কেজি গাঁজাসহ বাহাউদ্দিন বাবুল (৩০) ও মনির হোসাইন (২০) নামের দুই মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে। মেজর মেহেদী জানান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতেই এমন কৌশল নিয়েছিল তারা। আগে তারা এভাবে অনেক মাদকের চালান দেশের বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে। মাদকের চোরাচালান থেমে নেইÑ স্বীকার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশনস) পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) এস এম মাসুম রাব্বানী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এই করোনার সময়েও কিন্তু আমরা বসে নেই। গত মাসেই আমরা সিরাজগঞ্জ থেকে এক কেজি হেরোইন উদ্ধার করেছি। ফেনসিডিল এবং গাঁজার চাহিদা অনেক বেড়েছে বলে আমাদের কাছে খবর রয়েছে। সীমান্তে আরও কঠোরতা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি। তবে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উদ্ধারকৃত চোরাচালানের মাত্র ১০ ভাগের এক ভাগ উদ্ধার করতে পারে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। বর্তমান মহামারীর সময়টার সদ্ব্যবহার করছে চোরাচালানীরা। র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপস্্) কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার বলেন, করোনা মোকাবিলার পাশাপাশি র‌্যাব সদস্যরা আগের মতোই অপরাধ দমনে সক্রিয়। বিভিন্ন অপরাধের রহস্য উন্মোচন, সাইবার অপরাধীদের আইনের আওতায় আনাসহ অনেক সফলতাও এসেছে। জঙ্গিবাদ থেকেও কিন্তু আমরা আমাদের দৃষ্টি সরাইনি। এদিকে গত সপ্তাহের রবিবার ডিএমপির আদাবর থানার এএসআই নজরুল ইসলামের স্ত্রী আফরীন সুলতানা মুন্নী হত্যা রহস্য উদ্ঘাটন হয়নি। এর আগে ২৭ এপ্রিল দারুসসালামে ১৮ বছরের এক তরুণী ধর্ষণের শিকার হন। গত ১২ মে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেনকে নৃশংসভাবে খুন করে দুর্বৃত্তরা। অভিযোগ উঠেছে নি¤œমানের কাজের বিল উঠাইতে সহায়তা না করায় খুন হন তিনি। মানবাধিকার ফাউন্ডেশন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের তথ্যানুযায়ী, চলমান এই মহামারীর সময়ে ২৭ জেলায় ৩৫ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। গত এপ্রিলে চার হাজারের বেশি নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর বাইরে গত ৯ এপ্রিল রাজধানীর মগবাজার আউটার সার্কুলার রোডে মাদক নিয়ে রানা দাদা (৫০) নামের এক ব্যক্তি খুন হন। গত ২৬ এপ্রিল বাদামতলী ন্যাশনাল ব্যাংকের সামনে ১০ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। তবে ওই সময় চলমান র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানের সদস্যরা ছিনতাইকারীদের পাকড়াও করতে সক্ষম হন। গত ৩০ মার্চ গ্রিন রোডের কনকর্ড ভবনের আবাসিক ফ্ল্যাটে চুরির ঘটনা ঘটে। এ সময় ৪০ ভরি স্বর্ণ খোয়া যায়। ২৯ মার্চ দারুসসালামে বাজারপাড়া এলাকায় স্বামী গাউস হোসেনের হাতে খুন হন তার স্ত্রী নাদিরা বেগম (৩৭)। ২৮ মার্চ মীরহাজিরবাগে মাদকাসক্ত ছেলে সজীবের (১৭) হাতে খুন হন মা সুরাইয়া আক্তার। এর বাইরে প্রায়ই ছিনতাইয়ের ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। তবে থানা পুলিশের উল্টো হয়রানির ভয়ে ভুক্তভোগীদের অনেকে থানায় গিয়ে তা লিপিবদ্ধ করেননি। রাজধানীতে অপরাধ বেড়েছে এমনটা মানতে রাজি নন ডিএমপির কর্মকর্তারা। তাদের দাবি, করোনার কারণে অপরাধ প্রবণতা কমে এসেছে। আর বড় ধরনের অপরাধী ছাড়া সাধারণ অপরাধীদের ধরতে অভিযানও চালানো হচ্ছে না। মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা সবাই করোনা সংক্রান্ত দায়িত্ব পালন করছেন বেশি। এর কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেছেন, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে রাজধানীর ৫০টি থানায় মাসে গড়ে মামলা হয়েছে ২ হাজার ২০০টি করে। সেখানে এপ্রিল মাসে মামলা রেকর্ড হয়েছে ৩৪৯টি। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আবদুুল বাতেন বলেন, অপরাধের পরিসংখ্যান মিলিয়ে দেখুন নগরীতে অপরাধ অনেক কমেছে। তবে ছিনতাইয়ের ঘটনা কিছুটা আমাদের ভাবাচ্ছে। এ বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি। হয়তো অনেকে মনে করছেন পুলিশ শুধুই লকডাউন কিংবা করোনা মোকাবিলায় ভূমিকা রাখছে। এটা সত্য নয়, আমাদের মাত্র একটি অংশ এ কাজে নিয়োজিত। বাকিরা আগের মতোই দৈনন্দিন অপরাধ দমনের মতো কাজে সক্রিয় রয়েছেন।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর