শিরোনাম
সোমবার, ১ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

লিবিয়ায় যাওয়া অন্যদের ভাগ্যে কী আছে

খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না অর্ধশত যুবকের, পরিবারগুলোতে শোকের মাতম চলছেই, পেছনে থাকা বাংলাদেশি দালালদের আইনের আওতায় আনার দাবি

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

লিবিয়ায় পাচারকারীদের গুলিতে নিহত হওয়া ২৬ বাংলাদেশির মর্মান্তিক পরিণতির পর সেখানে যাওয়া অন্যদের নিয়ে তৈরি হয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। তাদের ভাগ্যে কী আছে তা নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা প্রশ্ন। এর উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও। অবৈধ পথে ইউরোপ যাওয়ার লোভে লিবিয়ায় যাওয়া প্রায় অর্ধশত বাংলাদেশি যুবকের বেশির ভাগের সঙ্গে পরিবারগুলোর যোগাযোগ নেই দীর্ঘদিন। লিবিয়ায় থাকা বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষেও সম্ভব হচ্ছে না তাদের খোঁজ নেওয়া। তারা নিয়মতান্ত্রিক কোনো পদ্ধতিতে সেখানে না যাওয়ায় নিখোঁজ থাকাদের সঠিক সংখ্যাও কারও জানা নেই। জানা যায়, লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা ও ১১ জনকে আহত করার নির্মম ঘটনায় দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দাবি করে ত্রিপোলির সরকারকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ। সেই চিঠির জবাব এখনো আসেনি। কিন্তু লিবিয়ার উদ্দেশে দেশ ছাড়া অন্য যুবকদের খোঁজ না পাওয়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে পরিবারগুলো। তারা জীবিত নাকি মৃত, এর কোনো সঠিক তথ্য মিলছে না। অনেক পরিবারের লোকজন জানেও না তাদের সন্তান আদৌ বেঁচে আছে কি না। অনেকে আবার হত্যাকান্ডের খবরও শোনেনি। মাদারীপুরের রাজৈরের হোসেনপুর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা নিখোঁজ জুয়েল হাওলাদারের বাবা রাজ্জাক হাওলাদার ও মা রহিমা বেগম বলেন, ‘আমাদের ছেলেসহ রাজৈরের বিভিন্ন এলাকার বেশ কয়েকজনকে দালাল চক্র লিবিয়া নেওয়ার কথা বলে প্রত্যেকের কাছ থেকে চার-পাঁচ লাখ টাকা চুক্তি করে দেশটিতে নিয়ে যায় তিন-চার মাস আগে। তারপর লিবিয়ার ত্রিপোলিতে না নিয়ে বেনগাজি নামে এক গ্রামে আটকে রেখে নির্যাতন শুরু করে। এরপর ভয়েস রেকর্ডে নির্যাতনের শব্দ পাঠিয়ে আরও ১০ লাখ টাকা দাবি করে। আমরা হোসেনপুরে জুলহাস শেখ নামের দালালের বাড়িতে গিয়ে ১০ লাখ টাকা দিয়ে আসি। মানুষের কাছে শুনতে পারছি লিবিয়ায় গুলি করে অনেক বাংলাদেশিকে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের ছেলে বেঁচে আছে কি না তাও জানতে পারছি না। এখন পর্যন্ত ছেলের কোনো খোঁজ পাই নাই।’ একই গ্রামের নিখোঁজ মানিক হাওলাদারের বাবা শাহ আলম হাওলাদার বলেন, ‘আমার ছেলে মানিককে লিবিয়া নেওয়ার কথা বলে দালাল জুলহাস আমার কাছ থেকে প্রথমে চার লাখ টাকা নিয়েছে। পরে ছেলেকে বেনগাজিতে আটকে রেখে ভয়েস রেকর্ডের মাধ্যমে ১০ লাখ টাকা দাবি করে সে। আমি আমার ছেলেকে আনতে জুলহাসের বাড়ি গিয়ে টাকা দিয়ে আসি। এখনো আমার ছেলের কোনো খোঁজ পাচ্ছি না।’ রাজৈর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শওকত জাহান বলেন, ‘লিবিয়ায় লোক নেওয়া দালাল জুলহাস শেখের রাজৈরের বাড়িতে এলাকাবাসী হামলা করে এমন সংবাদের ভিত্তিতে আমরা ওই বাড়িতে গেলে জুলহাস বলে আমার করোনা হয়েছে। করোনার কথা শুনে আমরা জুলহাস শেখকে মাদারীপুর সদর হাসপাতালের আইসোলেশনে ভর্তি করি।’

বাংলাদেশি দালালদের আইনের আওতায় আনার দাবি : লিবিয়ার নাগরিকদের চেয়ে এসব ঘটনার জন্য বাংলাদেশের মানব পাচারকারী ও দালালদের বেশি দোষ। কারণ তারাই প্রলোভন দেখিয়ে হতভাগ্য লোকগুলোকে বিদেশে নিয়ে যায় এ ধরনের পরিণতির জন্য। এই দালাল চক্রের সঙ্গে সরকারের যেসব ব্যক্তি জড়িত, তাদেরও গ্রেফতার করে শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এটি নিশ্চিত হলে কেবল লিবিয়াতে নয়, অন্যান্য দেশেও মানব পাচার বন্ধ হবে। অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মোহাম্মদ শহীদুল হক বলেন, ওই হতভাগ্য লোকগুলোর সবাই বাংলাদেশের নাগরিক এবং তাদের অধিকাংশ এ দেশ থেকে লিবিয়ায় গেছেন। ২০১৫ সালে এ ধরনের ঘটনা বেড়ে গেলে লোক পাঠানো বন্ধ করার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টে রিট করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ওই সময় এখানকার রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো যুক্তি দেখিয়েছিল যে বিদেশে অবস্থানকারী বাংলাদেশিদের মঙ্গলের দায়িত্ব সরকারের নয়। বাংলাদেশ সরকার এর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয় এবং এর ফলে কোর্ট সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে পক্ষে সিদ্ধান্ত দেয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যেহেতু লিবিয়াতে এখনো যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে, ওই রায় এখনো বলবৎ আছে বলে আমার ধারণা।’ সাবেক ওই সচিব প্রশ্ন তোলেন, ‘ওই লোকগুলো সঠিক কাগজ ছাড়া দেশের সীমানা কীভাবে পার হয়?’ একটি নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে মানব পাচার হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, এর সঙ্গে অনেকে জড়িত এবং তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে। একই মত পোষণ করে লিবিয়ায় বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত শহীদুল হক বলেন, ‘আমার সঙ্গে এক ব্যক্তির কথা হয়েছিল, যে এয়ারপোর্ট পার হয়েছিল। যে পাসপোর্ট নিয়ে সে পার হয়, সেটি তার নয়, ওই পাসপোর্টে লাগানো ভিসাও তার নয় এবং পাসপোর্টের ছবিও তার নয়। আরেকজন লোকের সঙ্গে কথা হয়েছে, যার কাছে বিএমইটির সঠিক ছাড়পত্র ছিল।’ এই দালাল চক্র মাদারীপুর, কিশোরগঞ্জ, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, সুনামগঞ্জসহ আরও কয়েকটি জেলায় বেশি সক্রিয় এবং এদের প্রায় প্রত্যেকের অফিস ঢাকার ফকিরাপুল এলাকায় বলে তিনি জানান। উল্লেখ্য, যে ২৬ জন মারা গেছেন এর মধ্যে ১১ জনের বাড়ি মাদারীপুর এবং সাতজনের বাড়ি কিশোরগঞ্জ। সাবেক রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমি যখন দায়িত্বে ছিলাম, তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অনেক দালালের নাম, ফোন নম্বরসহ অন্যান্য তথ্য পাঠিয়েছি এবং তখন কিছু গ্রেফতারও হয়েছিল।’ লিবিয়াকে ইতালি পাঠানোর একটি স্টেশন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি গোটা প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে বলেন, ‘এখানকার দালাল চক্র এই প্রলোভন দেখায় যে ইতালি পৌঁছে তারপর টাকা-পয়সার লেনদেন হবে। কিন্তু বাংলাদেশ ত্যাগ করার পর ওই লোকগুলো তিন থেকে চারবার বিক্রি হয়।’ তাদের লিবিয়া বা অন্য কোনো সুবিধাজনক স্থানে নিয়ে জিম্মি করা হয় এবং তাদের পরিবারের কাছে টাকা দাবি করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দেশে ও বিদেশে গোটা প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশিরা জড়িত।’ সাবেক রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমি নিজে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছি এবং তাদের কাছে সব তথ্য আছে। কে তাদের পাঠিয়েছে, কোন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দিয়েছে, তাদের ফোন নম্বর কী ইত্যাদি। এসব তথ্য নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি তাদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসে, তবে এ ধরনের ঘটনা রোধ করা সম্ভব হবে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শর্ষের ভূত আগে তাড়াতে হবে। এরপর বিদেশিদের শাস্তির জন্য বলতে হবে।’

সর্বশেষ খবর