বৃহস্পতিবার, ৪ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

সমস্যা এখন স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে

পরিবহন রাস্তাঘাট অফিস হাট-বাজার কোথাও মানা হচ্ছে না

নিজস্ব প্রতিবেদক

সমস্যা এখন স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে

মহাখালীতে গতকাল গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে বাসে উঠতে দেখা যায় -বাংলাদেশ প্রতিদিন

সরকারি-বেসরকারি অফিস খোলার পর সব ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানার নির্দেশনা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা মানা হচ্ছে না। কিছু অফিসে স্বাস্থ্যবিধি মানা হলেও বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চঘাট, বিভিন্ন মার্কেট, গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই। বাসস্ট্যান্ডে ভিড় করছেন যাত্রীরা। লঞ্চে উঠছেন গাদাগাদি করে। বিভিন্ন বাজারে কেনাকাটার জন্য ভিড় করছেন। চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছেন। ধীরে ধীরে নিজের চেনা রূপ ফিরে পেতে শুরু করেছে মেগাসিটি ঢাকা। কর্মচাঞ্চল্য বেড়ে যাওয়ায় রাজধানীতে বাড়ছে মানুষের চলাচল। দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে একরকম ফাঁকা থাকা ঢাকা এখন বেশ ব্যস্ত।

বড় বড় কিছু শপিং মল এখনো বন্ধ থাকলেও অনেক এলাকাতেই ফুটপাথে পসরা সাজাতে দেখা যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের। নাগরিকদের ব্যস্ততা আছে সেসব ঘিরেও। দু-একটি প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে নিচ্ছেন ফুটপাথ থেকেই। ফুটপাথে হেঁটে চলা মানুষের সংখ্যাও যেন বেড়েছে দু-একদিনে। বাদ নেই পাড়া-মহল্লার অলিগলিও। সীমিত পরিসর বা শারীরিক দূরত্ব মানা হোক বা না হোক, এলাকার মুদি, চায়ের দোকানগুলো ফিরে যাচ্ছে নিজেদের আড্ডাস্থলের রূপে। চায়ের কাপে ঝড় উঠছে করোনা পরিস্থিতি নিয়েই। এ ছাড়া পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন পাইকারি বাজারে দিন দিন ভিড় বাড়ছে। পাইকারি বাজারে মালামাল আনা-নেওয়ার জন্য ভ্যান, ঠেলাগাড়ি চলতে শুরু করেছে। প্রায়ই যানজট লেগে যাচ্ছে এসব এলাকায়। এ অবস্থায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে পুরান ঢাকার রাস্তায় চলাচলের উপায় নেই। এ ক্ষেত্রে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকিও বাড়ছে।

এ ছাড়া ফেরিঘাটে মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কারসহ ছোট ছোট যানবাহন নিয়ে মানুষের উপচে পড়া ভিড় দেখা যাচ্ছে। সামাজিক দূরত্বের বালাই নেই লঞ্চে। যাত্রীরা লঞ্চে যাচ্ছেন গাদাগাদি করে। লঞ্চের ডেকে যাত্রীর জন্য জায়গা চিহ্নিত করা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। প্রতিটি লঞ্চে ধারণক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ যাত্রী থাকছে। লঞ্চগুলোর ডেকে সাদা রং দিয়ে বৃত্ত এঁকে সামাজিক দূরত্ব রক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু লঞ্চ ছাড়ার সময় হতেই ভেস্তে গেল সব। বৃত্ত আর সামাজিক দূরত্বকে ‘দূরে’ ঠেলেই গাদাগাদি করে লঞ্চে ওঠেন যাত্রীরা। ফলে ঢাকা-বরিশাল দুই দিকেই সংক্রমণ আরও বাড়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। এদিকে প্রাণঘাতী করোনা সংক্রমণের মধ্যে সরকার ঘোষিত নির্দেশনা অনুযায়ী গণপরিবহন চালু হওয়ার তৃতীয় দিন ছিল গতকাল। টানা ৬৬ দিনের ছুটি শেষে রাজধানীতে চলাচল শুরু করেছে বাস। স্বাস্থ্য সুরক্ষা মেনে পরিবহন চালানোর নির্দেশনার পাশাপাশি সীমিত যাত্রী বহনের নির্দেশনা দিয়ে ৬০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে বাস ভাড়া। বাসে স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা নিয়ে যাত্রীরা নানা প্রশ্নের পাশাপাশি মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন অতিরিক্ত ভাড়া নিয়ে। শুধু আসনে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা ছাড়া অন্য কোনো স্বাস্থ্যবিধি মানছে না রাজধানীর গণপরিবহনগুলো। ফলে করোনাভাইরাস সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছেন গণপরিবহনের যাত্রীরা। বুধবার রাজধানী ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি বাসেই আসনের চেয়ে যাত্রীর সংখ্যা অর্ধেকেরও কম। সকালবেলা অফিসগামী যাত্রীদের চাপ থাকলেও বাসের ভিতরে সেই চাপ দেখা যায়নি। মিরপুর থেকে মতিঝিলগামী বাস কিংবা আজিমপুর থেকে উত্তরাগামী কোনো বাসেই অতিরিক্ত যাত্রী দেখা যায়নি। তবে বাসে ওঠার সময় যাত্রীর তাপমাত্রা পরীক্ষা করার কথা থাকলেও বেশির ভাগ গাড়িই তা করছে না। বাসে ওঠার সময় জীবাণুনাশক স্প্রেও করা হচ্ছে না। এ ছাড়া বাসের হেলপার প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে থেকে গায়ে হাত দিয়ে দিয়ে যাত্রী তুলছেন। এতে উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়ার। যাত্রীরা বলছেন, বাসের হেলপারকে প্রবেশপথে না দাঁড়িয়ে দরজার সামনে প্রথম সিটে বসতে হবে। সেখানে বসে ওঠার সময় যাত্রীর তাপমাত্রা পরীক্ষা করলে করোনার ঝুঁকি কমবে। শারীরিক দূরত্বও তৈরি হবে। কিন্তু হেলপার তো প্রতিদিন অসংখ্য মানুষকে স্পর্শ করছেন। এভাবে চললে গণপরিবহনের মাধ্যমেই করোনার ব্যাপক বিস্তার ঘটবে। দেখা যায়, অধিকাংশ গণপরিবহনেই তাপমাত্রা পরীক্ষার থারমাল স্ক্যানার নেই। ওঠার সময় যাত্রীদের স্প্রে করারও কোনো ব্যবস্থা নেই। যদিও সরকার গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধিতে সেসব শর্ত দিয়েছিল। কিন্তু এক আসন ফাঁকা রেখে বসা ছাড়া অন্য কোনো স্বাস্থ্যবিধি মানছে না পরিবহনগুলো। অবশ্য কিছু পরিবহনে দেখা গেছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহারসহ কিছু বিধি মানতে।

বিভিন্ন পরিবহনে দেখা যায়, শুধু আসনে বসার সময় শারীরিক দূরত্ব মানা ছাড়া অন্য কোনো স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই। তাড়াহুড়ো করে যাত্রী তোলার সময় গায়ে হাত দিচ্ছেন হেলপার। তবে অধিকাংশ যাত্রী মাস্ক পরেই যাত্রা করছেন। আকিক পরিবহনের যাত্রী শফিকুল ইসলাম বলেন, বাসে পুরোপুরি স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। করোনার সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো, হেলপার দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে যাত্রী তুলছেন। হেলপার সামনের আসনে বসে যাত্রী তুললে সেই ঝুঁকিটা অনেক কমে যাবে। পল্লবী পরিবহনের যাত্রী শামীমা বলেন, ‘গণপরিবহন চলাচল সরকারের তদারক করা উচিত। এরা অনেক কিছুই মানছে না। উইনার পরিবহনের একজন হেলপার বলেন, বাসে যাত্রী তোলার সময় থারমাল স্ক্যানার দিয়ে পরীক্ষা করে তুললে করোনাভাইরাস ঝুঁকি কমত। কিন্তু সে ব্যবস্থা আমাদের নেই। এ ছাড়া যাত্রী তোলার সময় সবাই তাড়াহুড়ো করেন। পরীক্ষা করে তোলার সময় কই!’ বসুমতি পরিবহনের হেলপার রাজীব বলেন, ‘এমনিতেই অর্ধেক যাত্রী নিয়ে আমরা চলাচল করছি। এর মধ্যে এক আসন আমি দখল করে বসলে কেমন হয়।’ কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি না মানলে তো মৃত্যুঝুঁকি রয়েছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এত কিছু চিন্তা করে লাভ নেই।’ মিরপুর থেকে মতিঝিলগামী ট্রান্স সিলভা পরিবহনের চালক জানান, মালিকের নির্দেশেই সিটে আলাদা প্লাস্টিক লাগানো হয়েছে। সব যাত্রী নেমে যাওয়ার পর পুরো বাস স্প্রে করা হয়। এ ছাড়া সরকার-নির্ধারিত রেটেই ভাড়া আদায় করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। বিভিন্ন রুটে গিয়ে আরও কয়েকজন বাসযাত্রীর সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, এখন পর্যন্ত যাত্রীসেবায় সন্তুষ্ট তারা। এদের বেশির ভাগই বাস ভাড়া একেবারে বেশি বাড়ানো হয়েছে এমন মত দিচ্ছেন। তবে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাত্রীসেবা দেওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন অনেকেই। তাদের কাছে ভাড়াটা সহনশীল মনে হয়েছে। মিরপুরগামী আরেক যাত্রী ফারুক বলেন, ভাড়া একটু বেশি মনে হচ্ছে। তবে যাত্রী কম আর স্টপেজ কম থাকায় সময় একটু কম লাগছে। ভাড়া একটু কম হলে ভালো হতো। কারণ সবার পক্ষে তো এই ভাড়ায় প্রতিদিন চলাচল করা সম্ভব নয়। ভাড়া বেড়েছে কিন্তু বেতন তো বাড়েনি!

 

সর্বশেষ খবর