শনিবার, ৬ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনা ঘিরে অসহায় চট্টগ্রাম

হাসপাতাল ও পরীক্ষা নিয়ে সংকট, আইসিইউর জন্য বিত্তবানরা ঢাকায়, গরিবের কেউ নেই

রেজা মুজাম্মেল, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ১০টি আইসিইউসহ ১১০ শয্যায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা চলছে। কিন্তু প্রতিদিনই রোগী ভর্তি থাকছেন ১২০ থেকে ১৩০ জন। সংকটাপন্ন অনেক রোগী অপেক্ষায় থাকেন, কখন আইসিইউর একজন রোগী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করছেন। অনেকে অপেক্ষার প্রহর গোনার সময়েই চলে যাচ্ছেন না ফেরার দেশে। অভিন্ন চিত্র চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের। এ হাসপাতালে ১০টি আইসিইউসহ ১১০ শয্যায় চলছে করোনা রোগীর চিকিৎসা। কিন্তু প্রতিদিনই করোনা ওয়ার্ডে রোগী ভর্তি থাকছেন ১৪০ থেকে ১৫০ জন। ওয়ার্ডের মেঝে ও বারান্দায়ও থাকতে হচ্ছে রোগীদের। এ পরিস্থিতি করোনাভাইরাসে চট্টগ্রামের অসহায়ত্ব করুণভাবে ফুটে উঠছে। রোগের ভারে ভারাক্রান্ত হাসপাতাল। নেই প্রয়োজনীয় সক্ষমতাসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। অন্তহীন ভোগান্তি-দুর্ভোগে মানুষ। বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন করোনা আক্রান্ত ও উপসর্গ থাকা রোগীরা। পুরো চট্টগ্রামে আইসিইউ মাত্র ২০টি ও সাধারণ শয্যা ৩২০টি। ফলে সঙ্গী হয়ে আছে শয্যা সংকট। আছে চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীসহ অন্যান্য জনবল সংকট। কর্মরতদের মিলছে না প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সামগ্রী। তারা ঝুঁকি নিয়েই কাজ করছেন করোনা ওয়ার্ডে। অন্যদিকে, করোনা উপসর্গ দেখা দেওয়া রোগীদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে নমুনা প্রদানে। বিত্তবানরা ঢাকাসহ বিভিন্ন আধুনিক হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগ পেলেও গরিব-অসহায় রোগীরা পড়ছেন ভোগান্তিতে।   

গতকাল শুক্রবার দুপুরে সরেজমিন চট্টগ্রামে করোনা চিকিৎসার দুটি হাসপাতালে দেখা যায় ‘তিল ঠাঁই আর নাহি রে’ অবস্থা। জেনারেল হাসপাতালে শয্যার চেয়ে রোগী বেশি। অতিরিক্ত রোগীর চাপে বিশৃঙ্খল অবস্থা। গতকাল ১১০ শয্যার হাসপাতালে ভর্তি ছিল ১২৫ জন। ওয়ার্ডের বাইরের অবস্থাও বেহাল। ড্রেনসহ যত্রতত্র পড়ে আছে ব্যবহৃত মাস্ক, পিপিই, গ্লাভসসহ নানা সামগ্রী। পাহাড়ের ওপর অবস্থান হওয়ায় রোগী পরিবহনে বেগ পেতে হয় স্বজনদের। হাসপাতালে প্রবেশের পথটি সরু হওয়ায় যাতায়াত করতে পারে না দুটি অ্যাম্বুলেন্স। ফলে অপেক্ষা করতে হচ্ছে জরুরি রোগী পরিবহন করা যানবাহনকে। হাসপাতাল এলাকায় নেই কোনো ফার্মেসি। এখানকার রোগীর স্বজন জসিম উদ্দিন বলেন, ‘করোনা ওয়ার্ডটি পাহাড়ের ওপর হওয়ায় একবার ওষুধ আনতে অন্তত আধা ঘণ্টা সময় লাগে। অন্যান্য সমস্যা তো আছেই।’ অন্যদিকে, চমেক হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডের ফ্লোর ও বারান্দায়ও রাখা হয়েছে রোগী। দুই রোগীর মধ্যে দূরত্ব বজায় রাখার কোনো সুযোগ নেই। ওয়ার্ডের ভিতরে-বাইরে রোগী-স্বজনদের ভিড়। শয্যার তুলনায় রোগী বেশি হওয়ায় চিকিৎসকদের ওপর বাড়ছে চাপ। গতকাল শুক্রবারও ১৪৫ জন রোগী ভর্তি ছিল। ২৫ জন রোগী থাকতে পারবে এমন ওয়ার্ডে ভর্তি আছে প্রায় দ্বিগুণ। ভর্তি থাকা ৭০ শতাংশ রোগীর দরকার হয় অক্সিজেন সাপোর্ট। একটি ওয়ার্ডে ১৮-২০টি বেডে অক্সিজেনের পোর্ট আছে। একটা পোর্ট দিয়ে চাহিদা মেটানো যায় একজন রোগীর। কিন্তু যারা এসব পোর্টের কাছাকাছি বেডে ফ্লোরিং করছেন তারা একটা পোর্ট থেকে ৪-৫ জন ভাগাভাগি করে অক্সিজেন নিচ্ছেন। তবে গতকাল সংকট কিছুটা কম ছিল। এক রোগীর স্বজন কামরুল ইসলাম বলেন, ‘হাসপাতালে রোগীর সেবা এবং অক্সিজেনের বিষয়টা এ রকম- মরুভূমিতে আপনার একবুক পিপাসা। এমন সময় আপনাকে বলা হচ্ছে থুথু গিলে পিপাসা নিবারণ করতে।’ চমেক হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আফতাবুল ইসলাম বলেন, ‘হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত ও উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীদের পৃথকভাবে রাখা হয়েছে। ১০০ শয্যায় রোগী ভর্তি করা হলেও প্রতিদিন ১৪০ থেকে ১৫০ জন পর্যন্ত ভর্তি থাকছে। উপায়ন্তর না থাকায় তাদের ভর্তি করাতে হয়। তবে নতুন করে মানসিক ওয়ার্ডকে করোনা ওয়ার্ড রূপান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এখানে প্রাথমিকভাবে ৩০ শয্যা করা যাবে। তা ছাড়া জনবল সংকট তো আছেই।’

জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. শফিকুল আলম বলেন, শয্যার বাইরেও রোগী ভর্তি করাতে হচ্ছে। এটি একটা বড় সমস্যা। কিন্তু কোনো উপায় নেই। তবে আমরা চেষ্টা করছি শয্যা বৃদ্ধির। তা ছাড়া সামনে আরও কিছু আইসোলেশন সেন্টার চালু করা হচ্ছে। তখন ওয়ার্ডে চাপ কমবে।’   

ভোগান্তির নাম নমুনা পরীক্ষা : চট্টগ্রামের নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে ফৌজদারহাটের বিআইটিআইডি ল্যাব, চমেক ল্যাব ও সিভাসু ল্যাব। এ তিনটি ল্যাবে আছে ছয়টি আরটি-পিসিআর মেশিন। প্রতিদিনই ল্যাবগুলোতে জমা পড়ছে ৭০০ থেকে ৮০০ নমুনা। তিনটি ল্যাবেই দৈনিক সর্বোচ্চ ৫০০ নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা আছে। ফলে ল্যাবে জমছে নমুনা। তা ছাড়া নমুনা প্রদানে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেতে হচ্ছে রোগীদের। প্রথমদিকে বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করা হলেও জনবল সংকটে তা বন্ধ করা হয়। এখন জেনারেল হাসপাতাল, চমেক ও বিআইটিআইডি ল্যাবে গিয়ে নমুনা জমা দিতে হয়। কিন্তু এ তিন স্থানেই প্রচুর ভিড়। ফলে নমুনা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বাড়ছে। জামাল খান এলাকার বাসিন্দা আবদুল্লাহ আল মামুন অভিযোগ করে বলেন, ‘জ্বর, কাশি ও স্বাদ ঘ্রাণও না পাওয়ায় নমুনা পরীক্ষা করাতে যাই চমেকে। কিন্তু সেখানে বাইরের ল্যাব থেকে আরও তিনটি টেস্ট করাতে বলে। সেগুলোর ফলাফল পেলে করোনা টেস্ট করবে কিনা সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। এসব দীর্ঘ প্রক্রিয়া।’ চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, ‘নমুনা পরীক্ষা নিয়মিত করাটা একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে তিনটি ল্যাবে সব মিলে ৫০০ পর্যন্ত করা যাচ্ছে। তা ছাড়া নগরে ছয়টি নমুনা সংগ্রহ বুথ চালু হয়েছে। প্রতিটি বুথও ৩০টি করে নমুনা সংগ্রহ করছে। তবে নতুন করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাব চালু হলে সংকট কিছুটা কমবে।’

সর্বশেষ খবর