সোমবার, ৮ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা
অষ্টম কলাম

ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমের অসঙ্গতি দূর করার দাবি

লাবলু আনসার, যুক্তরাষ্ট্র

জর্জ ফ্লয়েডের মতো আর কোনো আমেরিকানের প্রাণ যাতে কেড়ে নেওয়ার সুযোগ না থাকে, সে জন্য ক্রিমিনাল বিচার ব্যবস্থায় সংস্কারের দাবিতে ওয়াশিংটন ডিসি, নিউইয়র্ক, ফিলাডেলফিয়া, লস অ্যাঞ্জেলেস, মিনিয়াপলিস, ডেনভার, সিয়াটল, ডালাস, হিউস্টন, শিকাগোসহ অর্ধশতাধিক সিটিতে দ্বাদশ দিবসের মতো শনিবারও লাখো জনতার বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ স্লোগানে সরব এ কর্মসূচির সময় অনেক স্থানেই ছিল না পুলিশের বাড়াবাড়ি। হোয়াইট হাউসের সামনে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ লেখা সড়কসহ লিংকন মেমোরিয়াল পার্কে ৫ লাখের অধিক আমেরিকানের সমাগম ঘিরে দেখা যায়নি পুলিশের কোনো বাড়তি উপস্থিতি। সবকিছু ছিল স্বাভাবিক এবং প্রায় সবগুলো কর্মসূচিই অহিংস নীতিতে একেবারেই শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এর ফলে আন্দোলনের মেজাজ নতুন রূপ লাভে সক্ষম হয়েছে। উল্লেখ্য, ৬ জুন জর্জ ফ্লয়েডের দ্বিতীয় আনুষ্ঠানিক স্মরণ-শ্রদ্ধাঞ্জলি-প্রার্থনা সমাবেশ হয় নর্থ ক্যারোলিনায় র‌্যাফোর্ড সিটির চার্চে। সেই চার্চের ভিতরে ছিলেন শ তিনেক বিশিষ্টজন। আর বাইরে ছিলেন হাজার হাজার ক্ষুব্ধ মানুষ, যার ৭৫ শতাংশেরও বেশি শ্বেতাঙ্গ, লাটিনো, এশিয়ান। সবাই জর্জ ফ্লয়েডের এই মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনাকে ‘বহু বছরের বর্ণবাদ নির্মূল’-এর অবলম্বন হিসেবে মনে করছেন। আগামীকাল মঙ্গলবার দুপুরে জর্জের তৃতীয় ও সর্বশেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি-স্মরণ-প্রার্থনা সমাবেশ হবে টেক্সাসের হিউস্টন সিটিতে। সেখানেই তাকে সমাহিত করা হবে। ধারণা করা হচ্ছে, জর্জকে সমাহিত না করা পর্যন্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবে রচিত বর্ণবাদ নির্মূলের দাবিতে চলমান আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। করোনা মহামারীতে বিপর্যস্ত আমেরিকায় জর্জকে হত্যার নৃশংসতম ঘটনায় জেগে উঠেছে আমেরিকানরা। লকডাউনের বালাই নেই কোথাও। শনিবার সবচেয়ে বড় সমাবেশটি হয় হোয়াইট হাউসের সামনে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার প্লাজা’ ঘিরে আশপাশের রাস্তায়। কর্তব্যরত পুলিশের ধারণা, কমপক্ষে ৫ লাখ মানুষের সমাবেশ ঘটেছে। আয়োজকরা অবশ্য আশা করেছিলেন ১০ লাখ। তবে এ সমাবেশে অংশ নিতে বিভিন্ন স্থান থেকে মিছিল করে আসার সময় পুলিশ কোথাও বাধা দিয়েছে বলে শোনা যায়নি। সমাবেশের অঘোষিত ‘হোস্ট’ ছিলেন ওয়াশিংটন ডিসির মেয়র মুরিয়েল বাইসার। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির এই নারী মেয়র প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে শুধু এই সমাবেশই করলেন না, এর ২৪ ঘণ্টা আগে হোয়াইট হাউসে প্রবেশের রাস্তায় বিশাল আকারে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ লিখে পুরো রাস্তার নামকরণও করেছেন। সেখানকার একটি কর্নারের নাম দিয়েছেন ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার প্লাজা’। উল্লেখ্য, এ স্থানে গত সোমবার বিকালের শান্তিপূর্ণ একটি কর্মসূচিতে আকস্মিকভাবে হামলা চালায় ন্যাশনাল গার্ডসহ দাঙ্গা পুলিশের দল। স্বৈরাচারী আচরণে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দলবল নিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হোয়াইট হাউস থেকে হেঁটে সেন্ট জোন্স এপিসকোপাল চার্চে যান। আগের দিন বিক্ষোভের সময় কে বা কারা ওই চার্চে আগুন দিয়েছিল। সেটি দেখতে এবং চার্চের সামনে দাঁড়িয়ে ছবিতে পোজ দেন ট্রাম্প। অর্থাৎ ধর্মীয় অনুভূতিকে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে প্রেসিডেন্ট ব্যবহারের চেষ্টা করেছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সেই স্বৈরাচারী মনোভাবের প্রতিবাদেই রাস্তার নামকরণ করা হলো চলমান বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের মূল স্লোগানে। এদিকে গত কয়েক দিনের উত্তেজনার কিছুটা পরিসমাপ্তি ঘটায় ওয়াশিংটন ডিসি, ডেনভার, মিনিয়াপলিস, সেন্ট পোল, আটলান্টা, লস অ্যাঞ্জেলেসসহ বড় কয়েকটি এলাকা থেকে কারফিউ প্রত্যাহার করা হলেও নিউইয়র্ক, ফিলাডেলফিয়া, শিকাগো, বাফেলো, মায়ামি প্রভৃতি সিটিতে তা সোমবার (আজ) সকাল পর্যন্ত বহাল রাখার কথা সংশ্লিষ্ট সিটি প্রশাসন জানিয়েছে। এদিকে পুলিশি আইন তথা ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমেই বিশেষ সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে বর্ণবিদ্বেষমূলক আচরণের সুযোগ থাকায় ৪০১ বছর ধরেই কৃষ্ণাঙ্গরা নিগৃহীত হচ্ছেন বলে এবারের আন্দোলনের মূল দাবি হচ্ছে ‘আইনের সংস্কার’। ইতিমধ্যে মিনিয়াপলিস সিটি কাউন্সিল সে ধরনের আচরণকে নিষিদ্ধ করেছে। নিউইয়র্কের স্টেট গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমো ঘোষণা দিয়েছেন, শিগগিরই স্টেট পার্লামেন্টে এ ধরনের সংস্কারের একটি বিল পাস করা হবে। কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি বলেছেন, ৮ জুন সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমে বর্ণবাদ অসমতার যে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে, তা পরিবর্তনের লক্ষ্যে একটি বিল উত্থাপন করা হবে। কংগ্রেসনাল ব্ল্যাক ককাস এই বিলের খসড়া তৈরি করেছে বলে বৃহস্পতিবার তিনি জানিয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যাতে অভিযুক্তদের গ্রেফতারের সময়েই হত্যার কোনো সুযোগ না পান সে ব্যবস্থা থাকবে নতুন বিধিতে। পুলিশসহ নিরাপত্তা বাহিনীর সব সদস্যকে বডি-ক্যামেরার আওতায় আনার প্রসঙ্গও থাকতে পারে। পেলোসি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন, আফ্রিকান-আমেরিকানরা যাতে সর্বস্তরেই সমান সুযোগ-সম্মান লাভে সক্ষম হন সেদিকেও নজর রাখা হচ্ছে। পেলোসি বলেন, এটি করা হচ্ছে সর্বস্তরের বিচারহীনতা দূর করার জন্য। আর্থিকভাবেও আফ্রিকান-আমেরিকানসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেকে বিমাতাসুলভ আচরণের শিকার হচ্ছেন। উচ্চ শিক্ষা লাভের ক্ষেত্র সংকুচিত রয়েছে আফ্রিকান-আমেরিকানসহ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য। সেসবও দূর করা হবে জর্জ ফ্লয়েডের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের অভিপ্রায়ে।

সর্বশেষ খবর