বুধবার, ১০ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

টাকার লোভে গরিব সাজলো বিত্তবানরা

গাইবান্ধা প্রতিনিধি

গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলায় প্রধানমন্ত্রীর মানবিক সহায়তার আড়াই হাজার টাকা পাওয়ার যোগ্যদের তালিকা তৈরিতে ব্যাপক অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি আর নয়ছয়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। উপজেলার ১১ ইউনিয়নের প্রায় ৭ হাজার পরিবারকে সহায়তা দিতে জনপ্রতিনিধিরা উপজেলা প্রশাসনের কাছে যাচাই-বাছাই করা খসড়া তালিকা জমা দেন। কিন্তু সেই তালিকায় নানা ধরনের গরমিল আর অসঙ্গতি। অধিকাংশ ইউনিয়নের তালিকায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, তার আত্মীয়-স্বজন, আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী এবং তাদের পরিবারসহ পছন্দের লোকজনের নাম ঢোকানো হয়েছে। তালিকায় প্রকৃত দরিদ্র ও কর্মহীন মানুষের নাম বাদ পড়েছে; ঢুকছে ব্যবসায়ী, পাকা বাড়ির মালিক, সচ্ছল আর বিত্তশালীদের নাম। এমনকি তালিকাতে অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী, স্কুল, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তি এবং একই পরিবারের একাধিক সচ্ছল ব্যক্তির নামও আছে। এ ছাড়া এই টাকা হাতিয়ে নেওয়ার মতলবে অনেক জনপ্রতিনিধি এবং দলের নেতা দরিদ্র মানুষের নামের পাশে নিজের ও স্বজনদের একই মোবাইল নম্বর দুই-তিনবার জুড়ে দিয়েছেন। ইতিমধ্যে তালিকাভুক্ত এসব সুবিধাভোগীর কেউ কেউ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা পেয়েও গেছেন। সাদুল্লাপুর উপজেলার বনগ্রাম, দামোদরপুর, জামালপুর, কামারপাড়া ও রসুলপুরসহ কয়েকটি ইউনিয়নের তালিকা যাচাই ও বিশ্লেষণে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি ও নয়ছয়ের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। ১১ নম্বর খোর্দ্দকোমরপুর ইউনিয়নের ৫৯৪ জনের নাম রয়েছে তালিকায়। আত্মীয়-স্বজন ছাড়াও নিজের পছন্দের অনেক ব্যক্তির নাম অন্তর্ভুক্তের অভিযোগ উঠেছে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আরিফুর রহমান চৌধুরী শামীমের বিরুদ্ধে। সহায়তার এই টাকা হাতিয়ে নিতে তালিকার ৩২১ নম্বরে তিনি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যানের স্ত্রী, ৩৫২ ও ৩২২ নম্বরে রিনা ও নাজমা নামে সংরক্ষিত দুই নারী সদস্যকে বানিয়েছেন কৃষক ও দিনমজুর। তালিকার ২২০, ২২৭ ও ২২৯ নম্বরে ওই দুই ওয়ার্ড সদস্যের তিন ছেলের নামও রয়েছে। তার বিরুদ্ধে তালিকার ১৮১ ও ৩১২ নম্বরে খতিজা ও নাহিন নামে দুই দরিদ্রের নামের পাশে নিজ স্ত্রী ও মেয়ের মোবাইল নম্বর ব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে। শুধু তাই নয়, তালিকার ২০০, ২৬৭, ২৮৩, ৩০৩, ৩০৪, ৩০৮, ৩১০ ও ৩১১ নম্বরসহ হতদরিদ্র অন্তত ১২ জনের নাম ও ভোটার আইডি কার্ড ঠিক থাকলেও চেয়ারম্যান তার ব্যক্তিগত কাজের লোক রাজ্জাকের (০১৭৮৯৪৮৪০২৯) এবং আরও তিনটি মোবাইল নম্বর জুড়ে দিয়েছেন তাদের নামের পাশে। এর মধ্যে চেয়ারম্যানের মেয়ে এবং ব্যক্তিগত কাজের লোক রাজ্জাকের মোবাইল নম্বরে টাকাও এসেছে। আর ২৯১ নম্বরে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী, ৫৪৬ নম্বরে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক নুর আলম ও ৪২৮ নম্বরে ইউনিয়ন কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক এছাহাক আলী নাম অন্তর্ভুক্ত করে নিজেরাই সেজেছেন হতদরিদ্র আর দিনমজুর। তালিকার ১৯৪ নম্বরে অন্য সুবিধাভোগীর নামের পাশে নিজের মোবাইল নম্বর দিয়েছেন এছাহাক আলী। পাশাপাশি তালিকার ৫৪৫ নম্বরে আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ আলীর আপন ভাই মাহাবুর ও ২৪১ নম্বরে তারই স্ত্রী মনোয়ারা বেগমের নামও আছে। তালিকার ২৬৯ ও ২৭০ নম্বরে রয়েছে রবিউল ও লুৎফর নামে সহোদর দুই ভাই। অথচ তারা দুজনেই অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী হলেও তালিকাতে কৃষক পেশা উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া তালিকার ৩৪৩ ও ৩৪৯ নম্বরে বাবা-ছেলে, ৩৪০ ও ৩৪৪ নম্বরে মা ও ছেলে, ৫৮, ৫৯, ২৪১, ৫৪৫ ও ৪৯৩ এবং ৪৫৮ নম্বরে আছে স্বামী-স্ত্রীর নামও। তালিকার ২৪৭ নম্বরে ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোক্তা, ৪৬২ নম্বরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কর্মচারী, ২৫০ নম্বরে হাইস্কুলের কর্মচারী, ৪৫৭ নম্বরে সরকারি ঘর ও রেশন কার্ডের সুবিধাভোগীর নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ৪৯৩ ও ৪৯৪ নম্বরে দুজনের নাম থাকলেও মোবাইল নম্বর দেওয়া আছে অন্য ব্যক্তির এমনকি ১৮৫ নম্বরে থাকা ব্যক্তির মোবাইল ফোন নম্বর দেওয়া আছে বগুড়া গাবতলীর মহিষবান মধ্যপাড়ার অন্য একজনের।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, হতদরিদ্রদের বঞ্চিত করে আত্মীয়-স্বজনসহ নিজের পছন্দের লোকজনের তালিকা করেছেন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আরিফুর রহমান চৌধুরী শামীম। তালিকায় নাম থাকলেও মোবাইল নম্বর জালিয়াতির করে চেয়ারম্যান তার পরিবারের লোকজন ছাড়াও ব্যক্তিগত লোকজনের মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে বিশেষ সহায়তার টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ফুলবাড়ী গ্রামের হালিম বলেন, ‘২৫০০ টাকা পাওয়ায় চেয়ারম্যান তার কাছে ৫০০ টাকা দাবি করলে ওই টাকা দেন তিনি। তার মতে চেয়ারম্যান অনেকের কাছে দাবি করে টাকা আদায় করছেন’। একই গ্রামের চামেলি বেগম বলেন, ‘তার শ্বশুর অসুস্থ হয়ে বাড়িতে পড়ে আছেন। শাশুড়িসহ তার ভোটার আইডি কার্ড ও মোবাইল নম্বর চেয়ারম্যানকে দিয়ে আসেন। কিন্তু তালিকায় তাদের নাম উঠলেও মোবাইল নম্বর দেওয়া আছে চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত লোক রাজ্জাকের। এমন প্রতারণার জন্য রাজ্জাক ও চেয়ারম্যানের শাস্তির দাবি জানান তিনি। সুবিধাভোগীদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের অভিযোগ অস্বীকার করে ইউপি চেয়ারম্যান আরিফুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘রমজান মাসে অল্প সময়ের মধ্যে তালিকা তৈরি করতে গিয়ে নানা অসঙ্গতি রয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা, পরিষদের সদস্য এবং উপজেলা পরিষদের দেওয়া নাম সমন্বয় করে ৫৯৪ জনের তালিকা জমা দেওয়া হয়। তবে তালিকা পাঠানোর পর তথ্য কেন্দ্রে মোবাইল নম্বর পরিবর্তন করে রাজ্জাকের নম্বর দেওয়া হয়েছে। ঘটনাটি পরবর্তীতে জানার পর রাজ্জাক ও উদ্যোক্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এ ছাড়া তার মেয়ের নম্বরে আসা টাকা ভুক্তভোগীর কাছে দেওয়া হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি’। তালিকায় অনিয়মের অভিযোগের বিষয় জানা আছে জানিয়ে সাদুল্লাপুর ইউএনও মো. নবীনেওয়াজ বলেন, ‘অনিয়মের বিষয়টি দ্রুত খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ গাইবান্ধা-৩ (সাদুল্লাপুর-পলাশবাড়ী) আসনের সংসদ সদস্য অ্যাড. উম্মে কুলসুম স্মৃতি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নগদ সহায়তার তালিকায় অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির ঘটনা তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে’।

সর্বশেষ খবর