বৃহস্পতিবার, ১১ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

ভিক্ষুক বাড়ছে সারা দেশে শ্রমিকরাও ভিক্ষা করছেন!

রুহুল আমিন রাসেল

মহামারী করোনাভাইরাসের প্রভাবে কোনো ধরনের আয়-রোজগার বা কাজ না পেয়ে পথে পথে ভিক্ষা করছেন নিঃস্ব ও হতদরিদ্ররা। তারা এখন গ্রাম থেকে শহরমুখী হচ্ছেন ভিক্ষাবৃত্তিতে। লকডাউনের আগে রাজধানীতে তুলনামূলক ভিক্ষুকের উপস্থিতি কম ছিল। কিন্তু এখন চারদিকে ভিক্ষুকের হাহাকার। পথে পথে মানুষ বসে আছেন ভিক্ষা আর ত্রাণের অপেক্ষায়। সারা দেশেই ভিক্ষুক বাড়ছে। বিভিন্ন পেশার শ্রমিকরা কাজ না পেয়ে এখন ভিক্ষা করছেন বলে জানা গেছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, লকডাউনে সারা দেশেই ভিক্ষুক বেড়েছে। সামনের দিনগুলোতে ভিক্ষুক আরও বাড়বে। এ সংখ্যা এখন প্রাক্কলন করা কঠিন হলেও সংকট উত্তরণে শ্রমিকদের জন্য কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। এ উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা উন্নয়ন অন্বেষণের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, মহামারী করোনাভাইরাস উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এবং শঙ্কা বাড়িয়েছে। পৃথিবীতে নজিরবিহীন উৎপাদন বন্ধ। এটি দিন আনা দিন খাওয়া, সঞ্চয়হীন মানুষের বড় ধরনের আয় কমিয়েছে। এই আপৎকালীন সময়ে সর্বজনীন আয়-সহায়তা ও কর্মসংস্থান ধরে রাখা এবং খাদ্য-সহায়তা নিশ্চিত না করতে পারলে সামনে স্থিতিশীলতায় বড় রকমের টান পড়বে। এবারের বাজেটে বর্তমানে দরিদ্র ও নতুন দরিদ্র মানুষের ভোগব্যয় বৃদ্ধির জন্য নগদ সহায়তা প্রদান এবং সর্বজনীন জীবন ও অধিকারভিত্তিক সামাজিক নির্ভরতা কর্মসূচি নিশ্চিত করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের এই অধ্যাপকের মতে, ভিক্ষুকদের আয়ের ওপর, কর্মের ওপর চাপ পড়লে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়ে যাওয়ায় সামাজিক স্থিতিশীলতায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে। এদিকে দেশে এখন প্রকৃত কত মানুষ ভিক্ষাবৃত্তি করছেন, এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। এ নিয়ে কোনো জরিপও হয়নি। এ প্রসঙ্গে ১৩ জানুয়ারি জাতীয় সংসদকে সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশে এখন আড়াই লাখের মতো ভিক্ষুক রয়েছেন, যা মোট জনসংখ্যার শূন্য দশমিক ১৭ শতাংশ। তবে বাংলাদেশে ভিক্ষুকদের সংখ্যা নির্ধারণের জন্য সমন্বিতভাবে কোনো জরিপ হয়নি বলেও জানিয়েছেন মন্ত্রী। তিনি জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে পরিচালিত জরিপের তথ্যের ভিত্তিতে ভিক্ষুকের সংখ্যার হিসাব দিয়ে বলেন, ওই হিসাবেই দেশে শূন্য দশমিক ১৭ শতাংশ মানুষ ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। ভিক্ষুক পুনর্বাসনে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ও অলিগলির মোড়ে, মুদিদোকান, কাঁচাবাজার, ওষুধের দোকান, এটিএম বুথ বা বন্ধ হয়ে থাকা শপিং মলের সামনে এখন দেখতে পাওয়া যায় অসংখ্য অসহায় নারী। যারা কাউকে দেখলেই সাহায্য প্রার্থনা করছেন। সবার দ্বারে দ্বারে গিয়ে হাত পাতছেন। কেউ গাড়ির দরজা খুললেই সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন। এসব নারীর সঙ্গে শিশুসন্তানেরাও রয়েছেন। মায়ের সঙ্গে তারাও করুণ চাউনি নিয়ে তাকিয়ে থাকছেন কিছু পাওয়ার আশায়। বেশির ভাগ মধ্যবয়সী এই নারীরা কখনই ভিক্ষুক ছিলেন না। তারা ছিলেন শ্রমজীবী। এতদিন যেসব নারী গৃহশ্রমিকের কাজ করতেন, তারাও এখন ভিক্ষা করছেন বাধ্য হয়ে। কারণ বাসাবাড়িতে গৃহশ্রমিকদের ছাঁটাই করা হয়েছে। ফলে করোনাকালে গৃহশ্রমিকরা এখন অন্ধকার জীবনের সম্মুখীন হয়েছেন। জানা গেছে, মধ্যবয়সী এসব নারীর পোশাক-আশাক দেখেও কিছুটা আঁচ করা যায় যে তারা এর আগে এভাবে রাস্তায় নামেননি, তারা পেশাদার ভিক্ষুকও নন। শ্রমজীবী এসব নারী বিভিন্ন ধরনের কাজের সঙ্গেই সম্পৃক্ত ছিলেন। অনেকটা সামাজিক মর্যাদা নিয়েই তারা জীবন যাপন করতেন। কিন্তু সময়ের ফেরে এখন তাদের পথে নামতে হয়েছে। কথা বলে জানা গেছে, এরা কেউ বাসাবাড়ির গৃহশ্রমিক, কেউ নির্মাণ/মাটিকাটা শ্রমিক, কেউ বিভিন্ন মার্কেটে আলু-পিয়াজ বাছাই করা, কেউ হোটেল রেস্টুরেন্টে মসলা তৈরি করতেন, কেউ বিভিন্ন দোকানে সেলাইশ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। সামান্য যে বেতন পেতেন স্বামী আর নিজের আয় মিলিয়ে তারা ভালোই চলতেন। অনেকেই আবার বিধবা বা স্বামীপরিত্যক্তা হওয়ায় নিজের আয় দিয়েই কষ্ট করে চলতেন। কষ্ট হলেও মনে শান্তি ছিল এই বলে, চরম অনিশ্চয়তা বলে কিছু ছিল না। সচল ঢাকা শহরে অন্তত এই নিশ্চয়তা ছিল যে কিছু একটা কাজ করলেই দুই পয়সা আয় করা যেত। দু’মুঠো ভাতের সংস্থান করা যেত। করোনাভাইরাসের কারণে এ রকম নিম্ন বা স্বল্প আয়ের এই শ্রমজীবী সংগ্রামী নারীদের জীবনে নেমে এসেছে এক দুর্বিষহ অবস্থা, ঘোর অন্ধকার। বাসাবাড়িতে গৃহশ্রমিকরা যেতে পারছেন না। নির্মাণশ্রমিক হিসেবে যারা কাজ করতেন তাদের কাজও বন্ধ। রাজধানীর ধানমন্ডিতে একটি আবাসন প্রতিষ্ঠানের নির্মাণশ্রমিক রাফেজা। খানিকটা লিকলিকে শরীর তার। দিনমজুর হিসেবে রাস্তার কাজ করতেন। মাটি কেটে ট্রাকে তোলা, খোয়া ভাঙা, রাস্তায় বালু ফেলা, ইট ফেলার কাজ করতেন। প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা দিনমজুরি পেতেন। কিন্তু করোনার কারণে সেই কাজ বন্ধ। আজিমপুরে বাসা ভাড়া করে থাকেন শিউলি। তার স্বামী অসুস্থ, দুই সন্তানের জননী। নিজে কাজ করতেন চাঁদনী চকে একটি পোশাকের দোকানে দর্জি হিসেবে। পোশাক সেলাই, ফুল তোলা এসব কাজ করতেন। দিন হিসেবে মজুরি পেতেন। লেখাপড়াও জানেন তিনি। নিজের আয় করা টাকা দিয়ে সংসার চালাতেন। প্রতি মাসে ঘর ভাড়া তাকে দিতে হয় তিন হাজার টাকা। করোনার কারণে দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শিউলি মহাবিপদে পড়েছেন। হাতিরপুলের গৃহশ্রমিক রিজিয়া এর আগে কখনই ভিক্ষাবৃত্তি করেননি। ভূতের গলির একটি ফ্ল্যাটবাড়িতে কাজ করতেন। প্রতি মাসে বেতন হিসেবে সাড়ে চার হাজার টাকা পেতেন। কিন্তু করোনার কারণে সেই কাজ আপাতত বন্ধ। রিজিয়া থাকেন ঢাকা উদ্যানে। ৬০ বছরের বেশি বয়স তার। সংসারে দুই নাতি রয়েছে। বৃদ্ধ স্বামীসহ পাঁচজনের সংসার। ন্যাশনাল আইডি কার্ড গ্রামের হওয়ায় কমিশনার অফিস থেকে কোনো ত্রাণ পাননি। কমিশনার অফিসে গিয়েছিলেন। কিন্তু আইডি কার্ড দেখার পর ফেরত পাঠানো হয়েছে তাকে। এ পর্যন্ত যতটুকু খাদ্য সহায়তা পেয়েছেন তা অচেনা মানুষদের কাছ থেকেই। কী করবেন রিজিয়া? সবকিছু ফেলে রাস্তায় নেমেছেন।

সর্বশেষ খবর