শুক্রবার, ১৯ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

টাকার গাড়িই ওদের টার্গেট

করোনায়ও থেমে নেই, সক্রিয় আটটি ভয়ঙ্কর গ্রুপ গার্মেন্ট শ্রমিকদের বেতনের জন্য তোলা টাকা ছিনিয়ে নেওয়া হয়

সাখাওয়াত কাওসার

ওরা শ্রমিক ছদ্মবেশী সিন্ডিকেট সদস্যদের তথ্যের ভিত্তিতে আঁকে ডাকাতির ছক। ব্যাংক থেকে ওঠানো মোটা অঙ্কের টাকার গাড়িকেই অনুসরণ করা হয়। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সুযোগ বুঝে সময়মতো ওরা হামলে পড়ে ওই গাড়ির ওপর। লুট করে নিয়ে যায় গাড়িতে থাকা শ্রমিকদের বেতনের টাকা। অস্থির হয়ে ওঠে গার্মেন্টের পরিবেশ। সম্প্রতি র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার পাঁচ সদস্যের জবানিতে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর এই তথ্য। জানা গেছে, গার্মেন্টের টাকা লুট করতে আটটি সংঘবদ্ধ ডাকাত দল সক্রিয় রয়েছে মাঠে। র‌্যাব বলছে, চলমান মহাদুর্যোগময় পরিস্থিতে যে কটি কারখানা খোলা আছে এর শ্রমিকদের বেতনের টাকা লুটে নিতে সংঘবদ্ধ আটটি ডাকাত চক্র বিশেষ পরিকল্পনা করছে। এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা ঢাকা এবং ঢাকার উপকণ্ঠ গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের গার্মেন্ট কারখানায় শ্রমিকের ছদ্মবেশে তৎপর রয়েছে। গার্মেন্ট খাত নিয়ে কাজ করেন এমন কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বলছেন, এসব ঘটনা কি শুধুই ডাকাতি, নাকি গার্মেন্ট খাতকে অস্থির করতে এর পেছনে নেপথ্য কোনো ব্যক্তি বা সংস্থার ইন্ধন রয়েছে তাও খতিয়ে দেখা দরকার। তবে র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ডাকাত দলকে কেউ নেপথ্যে থেকে মদদ দিচ্ছেন এমন তথ্য এখনো আমরা পাইনি। তবে গ্রেফতার ব্যক্তিদের দুজন বিদেশে থাকে। মাঝেমধ্যে তারা দেশে এসে ডাকাতি করে আবার বিদেশে চলে যায়।’ তিনি বলেন, ডাকাত দলের এই ভয়ংকর পরিকল্পনা যাতে কোনোভাবেই সফল না হয় এ জন্য গোয়েন্দা নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। চক্রের সদস্যদের ধরতে র‌্যাবের একাধিক টিম কাজ করছে। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আটটি ডাকাত চক্রে রয়েছে শতাধিক সদস্য। তাদের কেউ শ্রমিক বেশে গার্মেন্টে কাজ করছে, কেউ সিকিউরিটির দায়িত্ব পালন করছে, আবার কেউ আবার গার্মেন্ট কারখানার ম্যানেজার, এমনকি বিভিন্ন ছুতায় গার্মেন্ট ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে সখ্য রেখে চলেছে। তাদের উদ্দেশ্য একটাই, শ্রমিকদের বেতনের টাকা ব্যাংক থেকে ওঠানোর পর কীভাবে ডাকাতি করবে তারা।

পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) মো. সোহেল রানা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ডাকাত দলকে নেপথ্যে থেকে কেউ উসকানি দিচ্ছে এমন তথ্য আমরা এখনো পাইনি। তবে ঘটনার তদন্তে সব সম্ভাবনাকেই আমরা বিবেচনায় রাখি।’ সম্প্রতি ইনক্রেডিবল নামে গাজীপুরের একটি গার্মেন্টের প্রায় এক কোটি টাকা ফিল্মি কায়দায় লুটে নেয় ডাকাত দলনেতা ও তার সহযোগীরা। এই চক্রের পাঁচজন সদস্যকে গ্রেফতার করে র?্যাব জানতে পেরেছে, আরও অনেক গার্মেন্টের বেতনের টাকা লুটের টার্গেট নির্ধারণ করেছিল তারা। এ চক্রের সদস্যরা ধরা পড়লেও আরও বেশ কিছু চক্রের সদস্যরা মাঠে তৎপর রয়েছে।

র?্যাব জানায়, ডাকাতির পাশাপাশি এরা মাদক, চাঁদাবাজি ও পতিতাবৃত্তির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এ চক্রের অনেক সদস্য এখনো অধরা। যেভাবে পরিকল্পনা : গ্রেফতার হওয়া চক্রের দলনেতা জলিল স্বীকারোক্তিতে র‌্যাবকে জানিয়েছেন, পাঁচ মাস আগে  সহযোগীদের নিয়ে গার্মেন্টের টাকা ডাকাতির পরিকল্পনা করেন তিনি। এ জন্য তিনি তথ্য সংগ্রহে ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইসমাইল হোসেন ও মনোরঞ্জন ম লকে নিয়োগ দেন। ইসমাইল ও মনোরঞ্জন তথ্য সংগ্রহ করে জলিলকে জানান। এরপর ডাকাতির চূড়ান্ত পরিকল্পনা করে নতুন অস্ত্র কেনেন তারা।

যেভাবে বাস্তবায়ন : প্রথম দুবার পরিকল্পনামাফিক লুটের পরিকল্পনা ভেস্তে যায় তাদের। তৃতীয়বারে মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যেই তারা গাজীপুর ইনক্রেডিবল ফ্যাশনস লিমিটেড নামে গার্মেন্টের শ্রমিকদের বেতনের ৮০ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করে ডাকাত চক্র। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কর্মী সেজে ওই গার্মেন্টে কৌশলে কাজ শুরু করে দলের সদস্যরা। ওই সদস্যরা ইনক্রেডিবল গার্মেন্টের শ্রমিকদের বেতন ক্যাশে প্রদান করা হয় এবং ব্যাংক থেকে টাকা সংগ্রহের সময় কোনো অস্ত্রধারী নিরাপত্তাপ্রহরী থাকে না বলে বাইরের সদস্যদের জানায়। জলিলের নির্দেশে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মনোরঞ্জন ওই গার্মেন্টে সাব-কন্ট্রাক্টের কর্মী হিসেবে মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে আসা-যাওয়া শুরু করেন। এর আড়ালে তিনি গার্মেন্টের অন্যান্য কর্মী, নিরাপত্তাপ্রহরী, পার্শ্ববর্তী দোকান ও অন্যান্য মাধ্যম থেকে কৌশলে তথ্য সংগ্রহ করেন। তার তথ্যের ভিত্তিতেই ডাকাতির পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়। তবে তাদের এপ্রিলে প্রথম এবং মে মাসে দ্বিতীয় দফায় তাদের ডাকাতির পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। কারণ এপ্রিলের বেতন দেওয়া হয়েছিল মোবাইল ব্যাংকিংয়ে এবং মে মাসের বেতনের টাকা সংগ্রহ করা হয়েছিল পুলিশ স্কটের মাধ্যমে। তবে জুনের বেতন সংগ্রহের সময় পুলিশ স্কট থাকবে না বলে নিশ্চিত হন তারা। ঘটনার প্রায় ১২-১৫ দিন আগে ইসমাইল, জলিল ও মনোরঞ্জন মাঠপর্যায়ে রেকি করে ডাকাতির জন্য সুবিধাজনক স্থান নির্বাচন করেন। পরে ৭ জুন ডাকাতির দিন নির্ধারণ করেন তারা। পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটনার দিন প্রথমে তিনটি মোটরসাইকেলে ছয়জন একটি সুবিধাজনক স্থানে মিলিত হন। ডাকাতির টাকা বহনের জন্য একটি প্রাইভেটকার জামগড়া নামক স্থানে অপেক্ষা করছিল। মনোরঞ্জন গার্মেন্ট এলাকা থেকে ডাকাত দলটিকে প্রতি মুহূর্তের তথ্য সরবরাহ করছিলেন। তার তথ্যের ভিত্তিতে সফিপুরে অপেক্ষমাণ তিনটি মোটরসাইকেল নিরাপদ দূরত্বে থেকে গার্মেন্টের মাইক্রোবাসটি অনুসরণ করতে থাকে। টাকা উত্তোলনের পর ফেরার পথে খাড়াজোড়া এলাকায় দুটি মোটরসাইকেল মাইক্রোবাসের সামনে গিয়ে কৌশলে ব্যারিকেড দেয়। এরপর লোহার হ্যামার দিয়ে মাইক্রোবাসের গ্লাস ভেঙে ফেলে এবং অতর্কিতভাবে মাইক্রোবাসের সামনের অংশে গুলি ছোড়া শুরু করে ডাকাতরা। ফিল্মি স্টাইলে ৮০ লাখ ২২ হাজার টাকা লুটে নেয় তারা। এ সময় গুলিতে মাইক্রোবাসে থাকা গার্মেন্টের সহকারী মার্চেন্ডাইজার রাজীব মজুমদার গুরুতর জখম হন। র?্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, মূলত ৮-১০ জনের একটি সিন্ডিকেট ইনক্রেডিবল গার্মেন্টে ডাকাতির ঘটনাটি ঘটিয়েছে। দলের মূল হোতা জলিলের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। নানা অপরাধে যুক্ত থাকায় গ্রেফতার এড়াতে তিনি ২০১৬ সালে প্রবাসে পাড়ি জমান। সাত-আট মাস আগে দেশে ফিরে আবারও ডাকাতির পরিকল্পনা করেন জলিল।

সর্বশেষ খবর