বৃহস্পতিবার, ২৫ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

ধার করে ঋণ পরিশোধ করবে সরকার

তিন বছরে সুদ পরিশোধে যে পরিমাণ ব্যয় হবে তা দিয়ে সাতটি পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব

মানিক মুনতাসির

ধার করে ঋণ পরিশোধ করবে সরকার

আগামী তিন বছরে ঋণের সুদ পরিশোধে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করবে সরকার তা দিয়ে অন্তত সাতটি পদ্মা সেতুর ব্যয় মেটানো সম্ভব। এই ঋণের বোঝা বাড়াচ্ছে মূলত সরকারের পরিচালন ব্যয় ও বাজেট ঘাটতি। একই সঙ্গে প্রতি বছরই সরকারের পরিচালন ব্যয় বাড়ছে। প্রস্তাবিত ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের আকার ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। এর প্রায় ৬০ শতাংশই ব্যয় হবে সরকারের পরিচালন খাতে, যার পরিমাণ ৩ লাখ ৪৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। চলতি বাজেটে এটা ধরা হয়েছিল ২ লাখ ৯৫ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে পরিচালন ব্যয় বাড়ছে ৫২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। আর এক বছরের ব্যবধানে সরকারের বাজেট ঘাটতি বাড়ছে ৪৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। ফলে ঘাটতি মেটাতে সরকারকে বেশি পরিমাণে ঋণ করতে হচ্ছে। আর এই ঋণের সুদও পরিশোধ করতে হচ্ছে বেশি পরিমাণে।

অন্যদিকে সরকারের উন্নয়ন ব্যয় বাড়লেও সংশোধিত বাজেটে প্রতি বছরই তা কমিয়ে আনা হয়। এই উভয় খাতের ব্যয় মেটাতে সরকারকে নির্ভর করতে হচ্ছে রাজস্ব আদায়ের ওপর। কিন্তু সেখানে কোনো বছরই শতভাগ লক্ষ্য অর্জিত হয় না। ফলে বাজেট ঘাটতি বেড়ে যায়। নতুন বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে এক লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। আর এই বিশাল ঘাটতি পূরণে সরকার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক এই দুই উৎস থেকে ঋণ করে থাকে। আগামী বছর শুধু ব্যাংক খাত থেকে প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেবে সরকার। আর চলতি বাজেটে সরকার এখন পর্যন্ত ৭৪ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে ব্যাংক খাত থেকে। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের সুদ বাবদ আগামী অর্থবছর (২০২০-২১) সরকারকে পরিশোধ করতে হবে ৬৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। আর পরের বছর (২০২১-২২) পরিশোধ করতে হবে ৭৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। একইভাবে এর পরের অর্থবছর (২০২২-২৩) এ খাতে সরকারের ব্যয় হবে ৮৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা, যা মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে (২০২০-২১ থেকে ২০২২-২৩) প্রকাশ করা হয়েছে। সেই হিসাব অনুযায়ী সরকার আগামী তিন বছর ঋণের সুদ বাবদ পরিশোধ করবে দুই লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা, যা দিয়ে অন্তত সাতটি পদ্মা সেতু নির্মাণের ব্যয় মেটানো সম্ভব। পদ্মা সেতুর সর্বশেষ (সংশোধিত) ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতি বছরই সরকারের পরিচালন ব্যয়ের সঙ্গে ঘাটতি বাজেট বাড়ছে, যার দরুণ সরকারকে বাজেট ঘাটতি মেটাতে ঋণ করতে হচ্ছে। এই ঋণের সুদ বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। কেননা সরকারের রাজস্ব আদায় যেভাবে হওয়ার কথা, সেভাবে হয় না। আবার অস্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার অভাব, অর্থের অপব্যবহার এবং সর্বোপরি প্রকল্পের উচ্চ ব্যয়ের কারণেও বাড়ছে এই ঋণ ও ঋণের সুদের বোঝা। ফলে সরকার যদি রাজস্ব আয় বাড়াতে পারত তাহলে বাজেট ঘাটতি সহনীয় থাকত। এতে ঋণ করতে হতো কম। ফলে অর্থের অপব্যবহারও কম হতো। কিন্তু সেটি করতে পারছে না সরকার। এর জন্য দরকার দক্ষ রাজস্ব প্রশাসন। অন্যদিকে সরকারের প্রকল্প ব্যয়ের ক্ষেত্রেও দরকার স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাজেট ঘাটতি কমাতে না পারলে সরকারকে ঋণ তো করতেই হবে। এজন্য প্রয়োজন রাজস্ব আদায় বাড়ানো। আর রাজস্ব আদায় বাড়াতে হলে রাজস্ব প্রশাসনের দক্ষতা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। একই সঙ্গে সরকারের করজাল বিস্তৃত করা প্রয়োজন। পাশাপাশি কর ফাঁকিবাজদেরও ধরতে হবে বলে তিনি মনে করেন। বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, সরকারের পরিচালন ব্যয় বাড়ছে। আবার উন্নয়ন ব্যয়ও বাড়ছে। কিন্তু উন্নয়ন ব্যয়ের যে ধারা, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে।  কেননা এখানে প্রকল্প ব্যয় নিয়েও বিভিন্ন প্রশ্ন রয়েছে। কোনো কোনো প্রকল্প অতি মূল্যায়িতও করা হয়। আবার কখনো কখনো অদক্ষতার কারণেও প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যায়। ফলে সরকারের ব্যয় সামাল দিতে গিয়ে বেশি পরিমাণে ঋণ করতে হয়, যার দরুণ ঋণের সুদ পরিশোধ করাটা একটা নিয়ম-নীতি মাত্র। এখান থেকে বেরোতে হলে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ানোর পাশাপাশি বাজেট ব্যয়ের স্বচ্ছতা-জবাবদিহিকে গুরুত্ব দিতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

সর্বশেষ খবর