রবিবার, ২৮ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা
কালো টাকা তৈরিতে এগিয়ে ঠিকাদারি ব্যবসা : ড. জামাল

মানহীন কাজে বেপরোয়া ঠিকাদাররা

স্বাস্থ্য এলজিআরডি সড়ক ও রেলের ঠিকাদারদের দুর্নীতি বেশি : দুদক । অনেক ঠিকাদার আয়কর বিবরণীতে প্রকৃত আয় দেখান না : টিআইবি । ঘুষ নেই কাজও নেই : ঠিকাদার সমিতির সভাপতি

রুহুল আমিন রাসেল

কারও কারও অবৈধ কর্মকান্ডে ঠিকাদার ও ঠিকাদারি ব্যবসা সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা নেতিবাচক। রডের বদলে বাঁশ কিংবা কঞ্চি দিয়ে সরকারি প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ অথবা উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা নয়ছয়ের ঘটনা তো আছেই। ঘুষের বিনিময়ে কাজ বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগের পাহাড় দূর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। স্বয়ং ঠিকাদার নেতার দাবি, ঘুষ ছাড়া কাজ মেলে না। সাধারণ ঠিকাদারদের ভাষ্য হলো, প্রতিটি ঠিকাদারি কাজে কমবেশি ৫ শতাংশ কালো টাকা তৈরি হয়। অর্থনীতিবিদদের মতে, কালো টাকা তৈরিতে সবচেয়ে এগিয়ে ঠিকাদারি ব্যবসা। অনেক ঠিকাদার আয়কর বিবরণীতে প্রকৃত আয় দেখান না। এসব কারণে সারা দেশে প্রায় লাখো ঠিকাদারের হাতে বিপুল কালো টাকা রয়েছে বলে মনে করা হয়।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ গত ২২ জুন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, এলজিআরডি, সড়ক ও রেলের ঠিকাদারদের নিয়ে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। এরা বেশি দুর্নীতি করছেন। সরকারি ক্রয়-প্রক্রিয়া বা উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে অনিয়ম হওয়ায় ঠিকাদারদের হাতে কালো টাকা তৈরি হচ্ছে। তাদের অবৈধ লেনদেনের কারণে কাজের মানও থাকছে না। এ ক্ষেত্রে ঠিকাদারদের আয়কর ফাইল খতিয়ে দেখছে দুদক। দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকারি ক্রয়-প্রক্রিয়া বৈধ বিষয়। কিন্তু এ বৈধতা নিশ্চিত না করেই যখন ঠিকাদারি কার্যক্রম করা হয়, তবেই অর্জিত অর্থ কালো টাকা হয়। অনেক ঠিকাদার হয়তো তাদের আয়কর বিবরণীতে প্রকৃত আয়ও দেখান না। তার মতে, সরকারি ক্রয়টাকে ধরে নেওয়া হয় অবৈধ উপার্জন। নিজেদের যোগসাজশে কালো টাকার মালিক হন ঠিকাদার ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ঠিকাদার, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তি মিলে এখানে ত্রিমুখী সিন্ডিকেট কাজ করে বলেও মত দেন ড. ইফতেখারুজ্জামান। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট-সিপিটিইউর জাতীয় ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট বা ইজিপি পোর্টালে গত ২২ জুন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যমতে, ২৭টি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসহ সারা দেশে মোট ৭৩ হাজার ৬২৫টি নিবন্ধিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ৬১টি একক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানই মূলত সরকারের ৪৭টি মন্ত্রণালয়, ২৭টি বিভাগ ও ১ হাজার ৩৪০টি সংস্থার উন্নয়ন, সরবরাহ ও সেবা প্রদানের কাজ করছে। ওই সংস্থাগুলোর আওতায় সারা দেশের ৯ হাজার ১৫৩টি ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান ই-টেন্ডারের মাধ্যমে ক্রয়কাজ সম্পাদনের জন্য নিবন্ধন করেছে। ওই পোর্টালের তথ্য বলছে, ইজিপি সিস্টেমটি সরকারের ক্রয়কারী সংস্থা (পিএ) ও ক্রয়কারী (পিই)-সমূহের ক্রয়কার্য সম্পাদনের জন্য একটি অনলাইন প্ল্যাটফরম। এটি একমাত্র ওয়েব পোর্টাল যেখান থেকে এবং যার মাধ্যমে সরকারি ক্রয়কাজ সম্পন্ন হয়। এ পদ্ধতি ক্রমান্বয়ে সরকারের সব প্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত হবে বলে এর মাধ্যমে সরকারি ক্রয়-প্রক্রিয়ায় দরদাতাদের অবাধ অংশগ্রহণ ও সমসুযোগ সৃষ্টি হবে।

জেলা পর্যায়ের কয়েকজন ঠিকাদার নাম প্রকাশ না করে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, টাকা ছাড়া সারা দেশে কোনো কাজ হয় না। সরকারি প্রকল্প পরিচালক, প্রকৌশলীসহ কর্মকর্তা থেকে পিয়ন পর্যন্ত সবাই মনে করেন, ঘুষের টাকা তাদের হক। এ টাকা ঠিকাদারদের দিতেই হবে। তবে ক্ষেত্রবিশেষ দু-একটি ব্যতিক্রমও আছে। একজন ঠিকাদারকে যে কোনো কাজে কমপক্ষে ৪ থেকে ৫ শতাংশ বাড়তি খরচ করতে হয়। আবার ভ্যাট ও কর হিসেবে অর্থছাড়ের সময় সাড়ে ১৩ শতাংশ কেটে রাখা হয়। অথচ সরকার ঠিকাদারদের ১০ শতাংশ কমিশন দেয়। ফলে ঠিকাদারের নিজস্ব ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অনেক সময় কাজের মান প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ঠিকাদার সমিতির সভাপতি সৈয়দ মোহা. শামসুল কাউনাইন কুতুব বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সারা দেশে লক্ষাধিক ঠিকাদার রয়েছেন। তাদের সবাইকেই কমবেশি আন্ডারহ্যান্ড ডিলিং করতে হয়। টাকা ছাড়া কাজ পাওয়া যায় না। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জুলুম করে ঘুষ নেন। ঘুষ নেই তো কাজও নেই। সমস্যা হলো, অনেক সময় ঘুষ বেশি দিতে হলে কাজের মানও থাকে না। প্রবীণ এই ঠিকাদার নিজের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘আগে যে কোনো প্রতিষ্ঠানের পিয়নকে ১০ টাকা দিলেই খুশি হতো। তারাও এখন ১ হাজার টাকার নিচে নেয় না। কর্মকর্তাদের কথা না হয় বাদই দিলাম।’

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশে কালো টাকা তৈরিতে এগিয়ে রয়েছে ঠিকাদারি ব্যবসা। তারা নিজেরা যেমন কালো টাকা তৈরি করছেন, তেমন অন্যকেও ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে কালো টাকার মালিক তৈরি করছেন। এ টাকা উদ্ধারের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে অর্থনীতি সমিতি। তিনি বলেন, সারা দেশে সব ঠিকাদারের সঠিক কোনো পরিসংখ্যানও নেই। তাদের একটি কেন্দ্রীয় ডাটাবেইস তৈরি খুবই প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞ গ্রুপ গঠন করে এসব ঠিকাদারের কাছ থেকে কালো টাকা উদ্ধারে এনবিআরের পদক্ষেপ প্রয়োজন বলেও মনে করেন রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের এই চেয়ারম্যান। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বারকাতের ‘বাংলাদেশে কালো টাকা এবং এর উৎস’ শীর্ষক জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি বছর দেশে দুর্নীতিসহ অনৈতিক পন্থায় ৭০ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়। প্রতি বছরই এ ধরনের লেনদেনের পরিমাণ বাড়ছে।

এমন প্রেক্ষাপটে আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত অর্থের বিনিয়োগের সুযোগ প্রসারিত করা হয়েছে। ফলে দেশের প্রচলিত আইনে যা-ই থাকুক না কেন, নতুন অর্থবছরে অপ্রদর্শিত অর্থের বিনিয়োগ নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবে না। এ আইনি নির্দেশনা আছে প্রস্তাবিত বাজেটে। এমন সুযোগ নিতে করদাতাদের অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে জমি, ফ্ল্যাট, বিল্ডিং ও অ্যাপার্টমেন্ট, ব্যাংক, সঞ্চয়পত্র, শেয়ারবাজার, বন্ড বা অন্য কোনো সিকিউরিটিজে। এ সুবিধা নিতে ১০ শতাংশ হারে আয়কর দিতে হবে। নেই কোনো জরিমানা। অপ্রদর্শিত অর্থের বিনিয়োগে অর্থ পাচার ও কর ফাঁকি কমবে। এ পদক্ষেপে অর্থনীতির মূল স্রোতে অর্থপ্রবাহ, কর্মসংস্থান ও রাজস্ব বৃদ্ধির আশা করছে সরকার। প্রস্তাবিত বাজেটে বিনিয়োগ ভুয়া ও অর্থ পাচার প্রমাণিত হলে ৫০ শতাংশ হারে আয়কর দিতে হবে। অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগ প্রশ্নে বাজেটে বলা হয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে করদাতার রিটার্ন দাখিলে অজ্ঞতার কারণে তাদের কিছু অর্জিত সম্পদ প্রদর্শনে ত্রুটিবিচ্যুতি থাকতে পারে। এ অবস্থায় করদাতাদের আয়কর রিটার্নের এ ত্রুটি সংশোধনের সুযোগ প্রদান এবং অর্থনীতির স্রোতে অর্থপ্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যে আয়কর অধ্যাদেশের আয়কর প্রণোদনাসংক্রান্ত দুটি ধারা সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়েছে। জানা গেছে, দেশের অর্থনীতিতে কালো টাকার প্রবাহ কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছে না। বিপুল পরিমাণ এ অর্থকে অর্থনীতির মূলধারায় ফিরিয়ে এনে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় যুক্ত করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন অনেকে। দেশে কালো টাকার সঠিক হিসাব পাওয়া না গেলেও এর পরিমাণ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় অর্ধেক বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, অবৈধ অর্থের মালিকরা তাদের অর্জিত টাকার অধিকাংশই বিদেশে পাচার করে দেয়। এর ক্ষুদ্র অংশই ব্যাংকে জমা থাকে। অবৈধ উপায়ে অর্জিত টাকার একাংশ ব্যক্তিগত ভোগবিলাসেও ব্যয় হয়।

সর্বশেষ খবর