বৃহস্পতিবার, ২ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

জলাবদ্ধতা থেকে ঢাকাবাসীর এবারও রেহাই নেই

জিন্নাতুন নূর

জলাবদ্ধতা থেকে ঢাকাবাসীর এবারও রেহাই নেই

এবারের বর্ষা মৌসুমেও রাজধানী ঢাকার বাসিন্দাদের জলাবদ্ধতা থেকে রেহাই মিলছে না। রাজধানীর জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধানে কিছু কাজ শুরু হলেও তা শেষ হয়নি। ফলে জলাবদ্ধতার ঝুঁকি বাড়ছেই। রাজধানীর বড় জলাবদ্ধতাপ্রবণ এলাকার মধ্যে রয়েছে- সচিবালয়, মিরপুর, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, নিকুঞ্জ-১ ও ২, রোকেয়া সরণি, সাংবাদিক কলোনি এলাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীর পানি নিষ্কাশনের প্রধান মাধ্যম খালগুলো অবৈধ দখল ও কঠিন বর্জ্যে ভরাট হয়ে আছে। নগরের খাল, ড্রেন, বক্স কালভার্ট ও ব্রিক স্যুয়ারেজ লাইন দিয়ে পানি নদীতে যেতে পারছে না। ফলে ভারি বর্ষণে শহরের অলিগলি, প্রধান সড়ক, ফুটপাথ পর্যন্ত তলিয়ে যায়। এরপরও টেকসই সমাধানে সরকারের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। শুধু মিটিং আর নির্দেশেই আটকে আছে এ-সংক্রান্ত কাজ।

ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রয়োজনীয় কর্মপন্থা নির্ধারণে ফেব্রুয়ারিতে সচিবালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগে একাধিক সভা হয়। সভায় এবারের বর্ষা মৌসুমেও রাজধানীর বেশ কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতা হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। জানা গেছে, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং বিআরটি প্রকল্পের উন্নয়ন কাজের কারণে রাজধানীর অনেকাংশে পানি নিষ্কাশন ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক অকেজো হয়ে পড়েছে। ফলে এবারের বর্ষায় জলাবদ্ধতা ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, মেট্রোরেলের উন্নয়ন কাজের কারণে মিরপুর-১০ থেকে আগারগাঁও তালতলা পর্যন্ত ওয়াসার ড্রেনেজ সিস্টেম অকেজো হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া বিজয় সরণির ‘বিমান চত্বর’ থেকে খামারবাড়ী হয়ে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত অকেজো হয়ে পড়েছে সিটি করপোরেশনের ড্রেনেজ সিস্টেম। ওই ড্রেনেজ সংস্কার করে দেওয়ার জন্য মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে। এতে তারা সিটি করপোরেশনকে ৯ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। টিসিবি ভবন সংলগ্ন ওয়াসার ড্রেনেজ ছিল, যেখান থেকে পানি হাতিরঝিলে যেত। সে সময় কারওয়ান বাজারে কোনো জলাবদ্ধতা হতো না। এখন পানি নিষ্কাশন ড্রেন ঘুরিয়ে দেওয়ায় হাতিরঝিলে জলাবদ্ধতা হচ্ছে। এবারের বর্ষার আগে হাতিরঝিল কর্তৃপক্ষ টিসিবি ভবনের সামনের পানি নিষ্কাশন গেটগুলো খুলে না দিলে সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করবে। এ ছাড়া হাতিরঝিলে সরাসরি পানি নিষ্কাশন বন্ধ করে দেওয়ার কারণে মগবাজারের নয়াটোলা এলাকার প্রধান সড়কে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) জলাবদ্ধতা হতে পারে এমন ১১টি এলাকা চিহ্নিত করে। ডিএনসিসির প্রকৌশল বিভাগ সূত্র জানায়, মিরপুর ১০ নম্বর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত সড়কে এবার জলাবদ্ধতার ভোগান্তি তীব্র হবে। রবিবার দিনভর থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ায় এ এলাকায় হাঁটুসমান পানি জমে যায়।  বিমানবন্দর সড়কের আর্মি স্টেডিয়াম থেকে বনানী ২৭ নম্বর পর্যন্ত সড়কের পশ্চিম পাশে প্রাকৃতিক জলাশয় ছিল। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কর্তৃপক্ষ এই জলাশয় ভরাট করে। পরে ডিএনসিসির নির্দেশনায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কর্তৃপক্ষ ভরাট করা খাল পুনঃখনন করে দিয়েছে। তবে খালের পাশের সড়কের ফুটপাথে পানি নিষ্কাশনের নালা নির্মাণের কাজ এখনো চলছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রকৌশল বিভাগ সূত্র জানায়, গত বছর সচিবালয়, মতিঝিল, ধানমন্ডি ২৭ থেকে আড়ং ক্রসিং, কাজী আলাউদ্দিন রোডসহ পুরান ঢাকার বেশ কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতা হয়। এবার কাজী আলাউদ্দিন রোড, নাজিরাবাজার এলাকায় বড় ব্যাসের নালা নির্মাণ করেছে ডিএসসিসি। ধানমন্ডি ২৭ নম্বরের মতো এলাকাগুলোর জলাবদ্ধতা নিরসনে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফকিরাপুল থেকে মতিঝিল হয়ে টিকাটুলী এবং আরও কয়েকটি এলাকায় কাজ চলছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে কাজ কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ওয়াসা সূত্র জানায়, উন্নয়ন কাজের ফলে মিরপুর ১০ নম্বর থেকে আগারগাঁও তালতলা পর্যন্ত সড়কের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ওয়াসার ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় মিরপুর ১০ নম্বর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত সড়কের পাশে ২ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার নতুন পাইপলাইন বসানো হবে। গত নভেম্বর থেকে সড়ক খোঁড়া নিয়ে চিঠি চালাচালি হয়। মার্চের মাঝামাঝি এসে কাজ শুরুর অনুমতি পায় ওয়াসা। জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার পরিকল্পনা ছিল সংস্থাটির। কিন্তু করোনার প্রভাবে কাজ বাধাগ্রস্ত হয়। এরই মধ্যে চলে এসেছে বর্ষা। অথচ কাজ পুরো শেষ হয়নি। জনগণের ভোগান্তি বিবেচনায় বর্ষা মৌসুমে খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ রাখা হয়েছে। অক্টোবর-নভেম্বর থেকে আবার কাজ শুরু হবে। তবে শেওড়াপাড়া পয়েন্টে যাতে পানি না জমে, সে ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম জানান, এরই মধ্যে জলাবদ্ধতা নিরসনে সুপরিসর আরসিসি পাইপ-নর্দমা নির্মাণের মাধ্যমে উত্তরার ৪ ও ৬ নম্বর সেক্টরের দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতা দূর করা হয়েছে। বনানী মেইন রোডের জলাবদ্ধতা নিরসনে বিমানবন্দর সড়কে বনানী ওভারপাস থেকে কাকলী পর্যন্ত রিটেনশন পন্ড পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া ফার্মগেট থেকে পরিকল্পনা কমিশন পর্যন্ত ডিএনসিসির প্রায় ২.২ কিমি ড্রেনেজ ব্যবস্থা সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি একই সঙ্গে জলাবদ্ধতা থেকে রেহাই পেতে ঢাকা ওয়াসার ড্রেনেজ সার্কেলের বিদ্যমান জনবল, যন্ত্রপাতি, প্রয়োজনীয় উপকরণ উত্তর সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রেজাউর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জলাবদ্ধতা নিরসনে আমরা যেসব পয়েন্টে কাজ করছিলাম তা প্রায় শেষ পর্যায়ে। এরই মধ্যে সচিবালয় ও মতিঝিল এলাকায় কাজ করেছি। এ ছাড়া বর্তমানে ধানমন্ডি ২৭ নম্বর এলাকায় আমাদের কাজ চলছে। করোনাভাইরাসের কারণে কাজ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’ তিনি বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে সিটি করপোরেশন মূলত সেকেন্ডারি কাজ করে থাকে। প্রাইমারি কাজ করে ওয়াসা। ওয়াসা যদি তাদের কাজ ঠিকমতো করে, তাহলে জলাবদ্ধতা হবে না। নগরবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের সভাপতি আকতার মাহমুদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে ড্রেনেজ ব্যবস্থার মাস্টার প্ল্যান করে ঢাকা ওয়াসা। গত ৩০ বছরে ওয়াসা ছয়টি প্ল্যান করেছে। সে হিসেবে তাদের বছর বছর এই প্ল্যান বাস্তবায়ন করার কথা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় তারা মাস্টার প্ল্যান করে ঠিকই, কিন্তু সেটি আর বাস্তবায়ন করে না। তারা শুধু প্রতিবছর একবার করে খালগুলোকে পরিষ্কার করে। আসলে এভাবে একবার খাল পরিষ্কার করে জলাবদ্ধতা নিরসন সম্ভব নয়। ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যানের সব প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন জরুরি। তিনি বলেন, ২০১৬ সালে জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়দায়িত্বগুলো সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু এ বিষয়ে এখনো অস্পষ্টতা রয়েছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে দুই পক্ষের সঙ্গে বসে এর সমাধান করা জরুরি।

সর্বশেষ খবর