সোমবার, ৬ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

ভাঙনে বিলীন হচ্ছে ঘরবাড়ি

বানভাসির ঠাঁই বাঁধ-সড়কে, খাদ্য সংকট তীব্র

নিজস্ব প্রতিবেদক

ভাঙনে বিলীন হচ্ছে ঘরবাড়ি

হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জে কালনী ভেড়মোহনা নদীর ভাঙন -বাংলাদেশ প্রতিদিন

করোনা দুর্যোগের মধ্যে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে হাজির হয়েছে বন্যা। ১৪ জেলায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ১৩ লক্ষাধিক মানুষ। কিছু নদীতে বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও এখনো বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কয়েকটি নদীতে এখনো পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন লাখো মানুষ। অসংখ্য বানভাসি মানুষ বিভিন্ন উঁচু বাঁধ এবং সড়কে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বন্যাদুর্গত এলাকায় চরম খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। হবিগঞ্জসহ অনেক এলাকায় প্রতিদিন নদীগর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে বসতভিটা, ফসলি জমি, স্কুল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। বন্যা পূর্বাভাস অনুযায়ী আজ সকাল ৯টা পর্যন্ত বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, নীলফামারী, টাঙ্গাইল ও জামালপুরে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, শরীয়তপুর, ফরিদপুর ও ঢাকায় বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে। যমুনা-ব্রহ্মপুত্রের পানি কমতে শুরু করেছে এবং তা আগামী ৪৮ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে। পদ্মার পানি স্থিতিশীল আছে। আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকতে পারে। গতকাল সন্ধ্যায় কুড়িগ্রামে তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি কমে বিপৎসীমার নিচ দিয়ে ও ধরলার পানি বিপৎসীমার ৪৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সিরাজগঞ্জে যমুনার পানি বিপৎসীমার ১৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। জামালপুরে বাহাদুরাবাদঘাট পয়েন্টে যমুনার পানি বিপৎসীমার ৩২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট ও তিস্তার পানি কমতে শুরু করেছে। তবে বাড়ছে করতোয়ার পানি।

দেশের পর্যবেক্ষণাধীন ১০১টি পানি সমতল স্টেশনের মধ্যে ৪৯টির পানি বৃদ্ধি পেয়েছে, কমেছে ৪৯টির। অপরিবর্তিত রয়েছে তিনটির।

গতকাল ত্রাণ ও দুর্যোগব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৪ জেলায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৩ লক্ষাধিক মানুষ। এর মধ্যে শুধু জামালপুরের সাত উপজেলায় ৪৯টি ইউনিয়নে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা তিন লাখ ৭৭ হাজার ৩৪৯ জন। দুর্যোগব্যবস্থাপনা অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী গাইবান্ধা সদরসহ পাঁচ উপজেলায় এক লাখ ২২ হাজার ৩২০ জন, সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলা ও পৌরসভায় এক লাখ ৫৯ হাজার ১৫৩ জন, সুনামগঞ্জের সব উপজেলায় মোট এক লাখ ৮৬ হাজার ৩২০ জন, বগুড়ার ধুনট, সারিয়াকান্দি ও সোনাতলায় ৭৬ হাজার ৬২০ জন, সিলেট সদরসহ ছয় উপজেলায় এক লাখ ৫৫ হাজার ৭২০ জন, টাঙ্গাইল সদরসহ ছয় উপজেলায় এক লাখ ২৩ হাজার ৯২৫ জন, কুড়িগ্রামের ৯ উপজেলায় ৬২ হাজার, লালমনিরহাট সদরসহ চার উপজেলায় ৪৮ হাজার ৫০০ মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ ছাড়া মানিকগঞ্জে এক হাজার ৪১৩ ও মাদারীপুরের শিবচরে এক হাজার ৯৫০ জন মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন।

বাংলাদেশ প্রতিদিনের বিভিন্ন জেলার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো সর্বশেষ তথ্যে জানা যায়-

হবিগঞ্জ : কালনী ভেড়ামোহনা নদীর অব্যাহত ভাঙনে বদলে যাচ্ছে হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলার মানচিত্র। নদীর পশ্চিমপাড়ে মাইলের পর মাইল চর জাগলেও পূর্ব পাড়ে ভেড়ামোহনার ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। গত কয়েক বছর ধরে চলা ভাঙনে কাকাইলছেও ইউনিয়নের সৌলরী, মণিপুর, বদরপুর, নজরাকান্দা, কাদিরপুর, জয়নগর ঋষিহাটি, শাহানগর, রুদ্রনগরসহ ১০টি গ্রামের প্রাচীন শত শত বসতভিটা, বাড়ি, মসজিদ, মাদ্রাসা বিলীন হয়ে গেছে। সব হারিয়ে অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন খোলা আকাশের নিচে কিংবা অন্যের বাড়িতে। কালনী-কুশিয়ারা, ভেড়ামোহনায় পানি বৃদ্ধির কারণে গত কয়েক দিনে সৌলরী লঞ্চঘাটসহ আশপাশের ৫০টি বাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এর আগে মণিপুর গ্রামের মসজিদ ও মাদ্রাসা নদীতে বিলীন হয়ে যায়। প্রতিদিনই কারও না কারও বাড়ি নদীভাঙনের কবলে পড়ছে। নদীভাঙন রোধে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।  হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মোহন লাল সৈকত বলেন, সৌলরীসহ ১০টি গ্রামের নদীভাঙন রোধে প্রায় ৩০ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

জামালপুর : টানা পাঁচ দিন ধরে যমুনার পানি কমতে থাকায় জামালপুরের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হয়েছে। তবে এখনো বাহাদুরাবাদঘাট পয়েন্টে যমুনার পানি বিপদসীমার ৩২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। পানি নেমে গেলেও নদী তীরবর্তী বসতবাড়ি এখনো বন্যার পানিতে তলিয়ে রয়েছে। তাই বন্যাদুর্গতরা এখনো বিভিন্ন উঁচু বাঁধ এবং সড়কে আশ্রয় নিয়ে আছেন। স্থানীয় ও আঞ্চলিক সড়ক থেকে বন্যার পানি নেমে গেলেও বিভিন্ন স্থানে সড়ক ভেঙে যাওয়ায় দুর্গত এলাকার মানুষদের চলাচলে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। ইসলামপুর উপজেলার আমতলী-বলিয়াদহ সড়ক ও উলিয়া-মাহমুদপুর সড়কের একাধিক স্থানে ভেঙে যাওয়ায় যানচলাচল বন্ধ রয়েছে। এদিকে কর্মসংস্থান না থাকায় বন্যাদুর্গত এলাকায় এখনো চরম খাদ্য সংকট রয়েছে। তবে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নতুন করে ১৫০ মেট্রিক টন চাল, নগদ দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত ৫৮৪ মেট্রিক টন চাল, নগদ ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। 

লালমনিরহাট : তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে একদিনের ব্যবধানে পানি বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার নিচে নেমে এসেছে। ফলে লালমনিরহাটের পাঁচটি উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে পানিবন্দী রয়েছে এখনো চরের অন্তত ২০ হাজার পরিবার। সেখানে দেখা দিয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট। তবে তিস্তার পানি কমলেও ধরলার পানি এখনো বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ধরলার পানি বেড়ে লালমনিহাটের পাটগ্রাম ও সদর উপজেলার কয়েক হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। তিস্তা ব্যারাজের ভাটিতে থাকা লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের বন্যাকবলিত মানুষগুলো বলেছেন, পানিবন্দী হয়ে অনাহারে থাকলেও এখন পর্যন্ত মেলেনি তেমন কোনো সহযোগিতা। লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক আবু জাফর জানিয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য ১২৫৩ মেট্রিক টন চাল, ১৩ লাখ ৪২ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যে কোনো সমস্যায় প্রশাসন পাশে থাকবে।

গাইবান্ধা : এ জেলায় ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট ও তিস্তার পানি কমতে শুরু করেছে। তবে বাড়ছে করতোয়ার পানি। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি ১৭ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ঘাঘটের পানি ১৯ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ৩ সেন্টিমিটার ওপরে রয়েছে। তিস্তার পানি ১০ সেন্টিমিটার কমেছে। করতোয়ার পানি ২৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে।

সিরাজগঞ্জ : যমুনা নদীর পানি কমলেও এখনো জেলায় লাখো মানুষ পানিবন্দী রয়েছেন। এসব মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করলেও কোনো সহায়তা পাননি বলে জানিয়েছেন। এ ছাড়া প্রতিদিন নদীভাঙনে বিলীন হচ্ছে বসতভিটাসহ ফসলি জমি। বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় দুশ্চিনায় কৃষকরা। জানা যায়, বর্তমানে যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমার ১৮ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে সিরাজগঞ্জ সদর, কাজিপুর, বেলকুচি, শাহজাদপুর ও চৌহালী উপজেলায় ৩৩টি ইউনিয়নের প্রায় ২১৬টি গ্রামের ২৫ হাজার পরিবারের দেড় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। চার শতাধিক বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সাড়ে তিন হাজার হেক্টর ফসলি জমি নষ্ট হয়েছে। ১৬ কিলোমিটার রাস্তা নষ্ট হয়েছে। এখনো নদীভাঙনে ঘরবাড়ি বিলীন হচ্ছে। সিরাজগঞ্জ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আবদুর রহিম জানান, বন্যাকবলিত উপজেলাগুলোর জন্য ২৬৭ টন চাল দুই লাখ ৪৮ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। দু-একদিনের মধ্যে এগুলো বিতরণ শুরু হবে।

কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামে তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি কমে বিপৎসীমার নিচ দিয়ে এবং ধরলা নদীর পানি কমে এখনো বিপৎসীমার ৪৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যাদুর্গত এলাকায় মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। এখনো অনেকের বাড়িঘরে পানি রয়েছে এবং নিম্নাঞ্চল তলিয়ে আছে। টানা এক সপ্তাহ ধরে বন্যার পানি অবস্থান করায় সংকটে রয়েছে দেড় লক্ষাধিক মানুষ। ফিরতে পারছেন না নিজ গৃহে। খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছেন অনেক পরিবার। বন্যাদুর্গত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। বিশুদ্ধ পানি সংকটে ডায়রিয়া, আমাশয় ও অন্যান্য পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য সেবা দিতে ৮৫টি মেডিকেল টিম কাজ করছে বলে জানিয়েছেন সিভিল সার্জন। জেলা প্রশাসন থেকে পর্যাপ্ত ত্রাণ বিতরণ করার কথা বলা হলেও কুড়িগ্রামে ত্রান নিয়ে সমন্বয়হীনতার অভিযোগ পাওয়া গেছে। জেলা প্রশাসক রেজাউল করিম বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ হওয়ায় অনেক জায়গায় ত্রাণ পৌঁছাতে দেরি হচ্ছে। তবে কেউ ত্রাণের বাইরে থাকবেন না। ইতিপূর্বে ৩০২ টন চাল ও ৩৬ লাখ ৬৮ হাজার টাকা বিতরণ করেছি। নতুন করে ২০০ টন চাল, নগদ তিন লাখ টাকা ও ২০ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার হাতে পেয়েছি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর