মঙ্গলবার, ৭ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

ঋণে পদে পদে ভোগান্তির শিকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা

প্রণোদনা প্যাকেজ

নিজস্ব প্রতিবেদক

মহামারী করোনাভাইরাস সংকটে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ চেয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পদে পদে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন বলে জানা গেছে। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো বলছে- প্রায় ৫৪ লাখ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এখন পুঁজির সংকটে হাবুডুবু খাচ্ছেন। এরসঙ্গে অনানুষ্ঠানিক খাতের অতি ক্ষুদ্র প্রায় ৬০ লাখ উদ্যোক্তা লকডাউনে ঘরে বসে পুঁজি খেয়ে ফেলেছেন। তারা এখন নিঃস্ব। তবুও অধিকাংশ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের পাশে নেই। এই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও অতি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের দ্রুত ঋণ প্রদানের তাগিদ দিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতারা।  এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন-এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সারা দেশের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পুঁজির সংকটে হাবুডুবু খাচ্ছেন। তাদের অবস্থা খুবই খারাপ। তারাই অর্থনীতির চালিকাশক্তি। কর্মসংস্থানও করেন বেশি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ব্যাংকগুলোর খুব একটা লেনদেন বা ঋণের সম্পর্ক নেই। কিন্তু করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত এই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অর্থায়ন জরুরি। এফবিসিসিআইর আরেক সাবেক সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেন, ছোট ব্যবসায়ীদের ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এসএমইদের ঋণ না দিয়ে অনুদান দিলে তারা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবেন। প্রণোদনার সব দায়িত্ব ব্যাংকগুলোর ওপর দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়নের সক্ষমতা ব্যাংকগুলোর নেই। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর সহায়তা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পাচ্ছেন না। কিন্তু ছোট ব্যবসায়ীদের ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যাংকগুলোতে জনগণের যে আমানত রয়েছে, তার নিশ্চয়তার জন্য গ্যারান্টি দরকার। এতে প্রান্তিক পর্যায়ের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ঋণ সুবিধা পাবেন।

এদিকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ নিয়ে একটি শ্রেণি বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছে, এমন অভিযোগ উত্থাপন করেছে এফবিসিসিআই। সংগঠনটি গত ২৭ জুন সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে প্রস্তাব করেছে- যেসব ব্যাংক মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে না, তাদের সরকারি আমানত প্রত্যাহার আর যারা পাশে দাঁড়াচ্ছে, তাদের আমানত বৃদ্ধি করার জন্য। মানুষের পাশে দাঁড়ানোর বাধা সৃষ্টিকারক ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার বিধান নিশ্চয়ই আছে। পেশাদার ব্যাংকার জানেন সহযোগিতার হাত কি করে বাড়াতে হবে। তাই প্রণোদনা বাস্তবায়নে ব্যাংকগুলোর কোনো বিষয়ে যৌক্তিক সমাধান প্রয়োজন হলে, আমরা একসঙ্গে সমাধান করব। অপরদিকে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন গতকাল বলেন, ব্যাংকগুলোর কাছে টাকা না থাকায় প্রায় ৫৪ লাখ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর অধিকাংশ ঋণ পাচ্ছেন না। এছাড়াও অতি ক্ষুদ্র অনানুষ্ঠানিক খাতের প্রায় ৬০ লাখ উদ্যোক্তা রয়েছেন। এদের ট্রেড লাইসেন্স, করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর-টিআইএন ও ভ্যাট নিবন্ধন কিংবা ব্যাংক হিসাব নেই। তাদের কেউ চায়ের দোকানদার, কেউ চটপটি বা বাদাম বিক্রেতা। এসব অতি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার সর্বোচ্চ পুঁজি ২০ হাজার টাকা। এই পুঁজি ৬৬ দিনের লকডাউনে বাসা ভাড়া আর ভরণ-পোষণে শেষ হয়ে গেছে। এখন তাদের হাতে কোনো পুঁজি নেই। এই অতি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের বাঁচাতে দ্রুত ঋণ দিতে হবে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে। তথ্যমতে, সদ্য শুরু হওয়া ২০২০-২০২১ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য স্বল্প সুদে ২ হাজার কোটি টাকা ঋণের ব্যবস্থা করেছে সরকার। চার আর্থিক প্রতিষ্ঠান পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক ও পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) মাধ্যমে এই ঋণ প্রদান করা হবে। কৃষি ও কৃষি সংশ্লিষ্ট উৎপাদন ও সেবা, ক্ষুদ্র ব্যবসা, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প ইত্যাদি গ্রামের দরিদ্র কৃষক, বিদেশফেরত প্রবাসী শ্রমিক, প্রশিক্ষিত তরুণ ও বেকার যুবাদের গ্রামীণ এলাকায় ব্যবসা ও আত্মকর্মসংস্থানমূলক কাজে স্বল্প সুদে ঋণ বিতরণের ব্যবস্থা সম্প্রসারণ করবে সরকার। পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক ও পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন- এ চারটি প্রতিষ্ঠানে ৫০০ কোটি টাকা করে মূলধন প্রদান করা হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো সুনির্দিষ্ট প্রোগ্রামের আওতায় উপযুক্ত উদ্যোক্তাদের কাছে স্বল্প সুদে ঋণ বিতরণ করবে বলে বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এমপি।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা উন্নয়ন অন্বেষণের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন- কুটির, প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে অর্ধেকের বেশি প্রতিষ্ঠান এবং উদ্যোগ বন্ধ হয়েছে। বিনিয়োগ কমেছে, ভোগ-ব্যয় কমেছে এবং আমদানি-রপ্তানিও কমেছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের আয় অর্ধেকে নেমে এসেছে। প্রণোদনা প্যাকেজের শর্ত সহজতর না হওয়ার কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি স্তরের উদ্যোক্তারা ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে এখনো ঋণ গ্রহণ করতে পারছে না। নারী উদ্যোক্তারা এ খাতের সব ঋণের কমপক্ষে ১৫ শতাংশ পাওয়ার কথা। এবারের বাজেটেও নারী উদ্যোক্তাদের বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে গেছে। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির তথ্যমতে, করোনাভাইরাস মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত সারা দেশের ৫৩ লাখ ৭২ হাজার ৭১৬টি প্রতিষ্ঠানের ক্ষুদ্র পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা পথে বসে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পাচ্ছে না। কারণ ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের পছন্দ না করলে ঋণ দেবে না। ব্যাংকগুলো সব সময় বড় ব্যবসায়ীদের পছন্দ করে। তাদের শত শত কোটি টাকা দিলেও, খুচরা ব্যবসায়ীদের কয়েক লাখ টাকা দিতে আগ্রহী নয় ব্যাংকগুলো। অথচ সারা দেশের ক্ষুদ্র পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের দোকানগুলোতে গড়ে ১৫ জন কর্মচারী রয়েছে। সে হিসাবে ৫৩ লাখ ৭২ হাজার ৭১৬টি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন ৯৭ লাখ ১৩ হাজার ৯২৯ জন কর্মচারী।

সর্বশেষ খবর