বৃহস্পতিবার, ৯ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

বন্যায় ভেঙে পড়েছে যোগাযোগব্যবস্থা

কমছে বন্যার পানি, মধ্য জুলাইয়ে ফের বৃদ্ধির শঙ্কা

নিজস্ব প্রতিবেদক

বন্যায় ভেঙে পড়েছে যোগাযোগব্যবস্থা

উত্তরাঞ্চলকে সুনামগঞ্জ জেলা সদরের সঙ্গে সড়কপথে যুক্ত করা সড়কটি বন্যার পানির তোড়ে ভেঙে গেছে -বাংলাদেশ প্রতিদিন

দেশে চলমান বন্যা পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে উন্নতির দিকে। গত কয়েকদিন ধরে পানি কমতে থাকায় অধিকাংশ নদীর পানি এখন বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বাড়ি ফিরতে শুরু করেছেন উঁচু সড়ক ও বাঁধে আশ্রয় নেওয়া অনেক মানুষ। তবে এখনো বিপৎসীমার ওপরে রয়েছে ৬টি নদীর পানি। বন্যার পানির তোড়ে রাস্তা, বাঁধ, কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ল-ভ- অনেক এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা। অন্যদিকে পানি নামতে না পারায় এখনো পানিবন্দী লাখো মানুষ। তলিয়ে আছে বীজতলা, সবজি খেত। নদী ভাঙনে বিলীন হচ্ছে বসতভিটা, কৃষি জমি। এর মধ্যেই উজানে ভারি বর্ষণের আভাস থাকায় পাহাড়ি ঢলে মধ্য জুলাইয়ে ফের বন্যা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কা প্রকাশ করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।

এদিকে পানি কমতে শুরু করলেও অনেক নদীতে এখনো পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। পাউবোর তথ্যানুযায়ী গতকাল বিভিন্ন নদ-নদীর ১০১টি পয়েন্টের মধ্যে ৭১টিতে পানি কমেছে, ২৮টিতে নতুন করে বেড়েছে। অপরিবর্তিত রয়েছে দুটি পয়েন্টে। বিপৎসীমার ওপরে রয়েছে ৬টি নদীর পানি। আগামী সপ্তাহের শেষ দিকে ভারি বর্ষণে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার পানি কমছে যা আগামী ২৪ ঘণ্টা অব্যাহত থাকবে। সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, রাজবাড়ীর বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে। গঙ্গা নদীর সমতল স্থিতিশীল থাকায় পদ্মা নদীর পানি কমছে, যা আরও ৪৮ ঘণ্টা অব্যাহত থাকবে। তবে মেঘনা অববাহিকায় আগামী ২৪ ঘণ্টায় পানি আবার বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। একইসঙ্গে দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন ভারতীয় এলাকায় আগামী ৭২ ঘণ্টায় ভারি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। এতে ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, মেঘনার উজানসহ বিভিন্ন নদীর পানি বৃদ্ধির শঙ্কা রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া গতকাল জানান, ‘ব্রহ্মপুত্র-যমুনার পানি ১০ জুলাইয়ের পর পুনরায় বাড়তে পারে। ১৩ জুলাই নাগাদ কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর ও সিরাজগঞ্জ জেলার বিভিন্ন পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপরে প্রবাহিত হতে পারে। গঙ্গা-পদ্মার পানি বাড়তে পারে। আগামী তিন দিন রাজবাড়ী, মুন্সীগঞ্জ ও শরীয়তপুরের বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। জুলাইয়ের মাঝামাঝি এসব জেলার বন্যা  পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে।

এদিকে বন্যার পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে শরীয়তপুর, মাদারীপুর, হবিগঞ্জ, জামালপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় নদীভাঙন বৃদ্ধি পেয়েছে। নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে বসতভিটা, রাস্তা, কৃষিজমি। বন্যার কারণে অনেক এলাকার রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ভেঙে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। আমাদের বিভিন্ন জেলার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন বন্যার সর্বশেষ পরিস্থিতি- সুনামগঞ্জ : বন্যায় সুনামগঞ্জের অধিকাংশ সড়কের ওপর থেকে উঠে গেছে বিটুমিনের প্রলেপ। অনেক সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। সদর-ডলুরা সড়কের নবীনগর এলাকায় পানির তোড়ে দুটি বড় ভাঙন তৈরি হয়েছে। এতে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ। এক পাশে যানবাহন রেখে ভাঙা স্থানগুলো নৌকায় পার হয়ে গন্তব্যে যাচ্ছেন যাতায়াতকারীরা। একইভাবে সদর-জামালগঞ্জ সড়কের ঘাঘটিয়া এলাকায় বন্যার পানির চাপে বড় ভাঙন দেখা দেওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েছেন লক্ষাধিক মানুষ। স্থানীয় সরকার বিভাগ জানায়, বন্যায় প্রায় ১০০ কিলোমিটার সড়কের বিভিন্ন স্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে প্রায় ৮০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে তাদের। এ ছাড়া সড়ক ও জনপথ বিভাগের পাঁচটি সড়কের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২ কোটি টাকারও বেশি বলে জানা গেছে। সরকারি অর্থের অপচয় রোধে স্থানীয়রা বন্যার পানি নিয়ন্ত্রণে স্থায়ী সমাধান দাবি করেছেন। রংপুর : রংপুর বিভাগে বন্যায় ডায়রিয়া আক্রান্তের সংখ্যা দুই শতাধিক ছাড়িয়েছে। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে বলে দাবি করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এ ছাড়া সাপের কামড় ও পানিতে ডুবে  কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধায় ৮ জনের বেশি মারা গেলেও এসব মৃত্যুর পরিসংখ্যান স্বাস্থ্য বিভাগে নেই। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে ৭০৯টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। টিমগুলো বন্যাদুর্গত এলাকাগুলোয় গিয়ে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেটসহ নানা ধরনের ওষুধ সামগ্রী বিনামূল্যে সরবরাহ করছে। তবে ত্রাণ প্রদানের অপ্রতুলতার অভিযোগ উঠেছে। রংপুর বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. আমিন আহমেদ খান বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগের সুষ্ঠু মনিটরিংয়ের কারণে এখন পর্যন্ত কোথাও স্ট্রং ডায়রিয়া দেখা দেয়নি।

তবে স্বাভাবিক ডায়রিয়া থাকতে পারে।

জামালপুর : যমুনার পানি বিপৎসীমার নিচে নেমে আসায় জামালপুরের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি ১০ সেন্টিমিটার কমে বুধবার বিকালে বাহাদুরাবাদঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বসতবাড়ি থেকে পানি নেমে যাওয়ায় বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে বন্যা দুর্গতরা। তবে যমুনা তীরবর্তী কিছু এলাকায় এখনো বন্যার পানি আটকে থাকায় বসতবাড়ি তলিয়ে আছে। ফসলি জমি, বিভিন্ন হাট-বাজারে এখনো পানি এবং কাদা জমে থাকায় এখনো কর্মসংস্থানে ফিরতে না পেরে চরম খাদ্য সংকটে রয়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ। ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ-খোলাবাড়ী সড়কের ৫০০ মিটার ভেঙে সরু হয়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। অবশিষ্ট অংশও নদীতে বিলীন হওয়ার অপেক্ষায়। এদিকে জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যানুসারে আগামী শনি-রবিবার থেকে আবারো পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ১২০ থেকে ১৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

গাইবান্ধা : গত তিন দিন থেকে করতোয়ার পানি বেড়েই চলেছে। গতকাল থেকে তিস্তাতেও আবার পানি বাড়তে শুরু করেছে। গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় করতোয়ার পানি ৪৭ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে আর তিস্তার পানি বেড়েছে ১৩ সেন্টিমিটার। তবে করতোয়া ও তিস্তা এখনো বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘটের পানি প্রতিদিনই কমছে এবং বিপৎসীমার অনেক নিচে রয়েছে।

লালমনিরহাট : চলতি বর্ষায় গজলডোবা বাঁধ দিয়ে ভারত পানি ছেড়ে দিলে তিস্তায় তিন ধাপে পানি বৃদ্ধি পেয়ে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ভাঙনে লালমনিরহাট জেলার হাতিবান্ধার গড্ডিমারী, শানিয়াজান, সিন্দুনা, পাটিকাপাড়া, ডাউয়াবাড়ী, কালীগঞ্জের ভোটমারী, আদিতমারীর মহিষখোচা, সদরের খুনিয়াগাছ, রাজপুর এলাকার চর ও নদতীরবর্তী এলাকার ২ শতাধিক ঘর-বাড়িসহ ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বিনবিনার চরের পাকাসড়কের প্রায় ৫০০ ফুট নদীগর্ভে চলে গেছে। বন্যা কবলিত এলাকায় খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে।

কুড়িগ্রাম : নদ-নদীর পানি কমে কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। ঘরবাড়ি থেকে পানি নেমে যাওয়ায় বাঁধে আশ্রয় নেওয়া অনেকেই বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে। তবে অনেকে আবারো বন্যার আশঙ্কায় বাঁধেই অবস্থান করছেন। বন্যা কবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ পানির অভাবে ডায়রিয়া, আমাশয়সহ নানা পানিবাহিত রোগ দেখা দিয়েছে। সেই সঙ্গে খাবার স্যালাইন ও ওষুধ সংকট রয়েছে। বন্যার পানিতে ফসল নষ্ট হয়ে চরম বিপাকে পড়েছে কৃষক। কৃৃষিবিভাগের তথ্য মতে, জেলায় ৯ হাজার ৭৮৯ হেক্টর জমির বিভিন্ন সবজি, পাট, বাদাম, কাউন, আমন বীজতলাসহ বিভিন্ন ফসল এবারের বন্যায় সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হয়েছে। এদিকে নদীর পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে ভাঙন শুরু হয়েছে সদর, উলিপুর ও রাজারহাট উপজেলার অনেক এলাকায়। সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ধস দেখা দিয়েছে। চারটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নদী ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। আরও একটি ভাঙনের মুখে রয়েছে। ১৫২টি বিদ্যালয়ের আংশিক ক্ষতি হয়েছে।

চাঁদপুর : চাঁদপুর শহর রক্ষা বাঁধের পুরান বাজার হরিসভা রোডে ফাটল দেখা দিয়েছে। একইসঙ্গে মেঘনার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যে কোনো সময় পানির তোড়ে মন্দির এলাকার বিস্তীর্ণ অংশ ভেঙে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে আতঙ্কিত স্থানীয় বাসিন্দারা। ভাঙন রোধ বালিভর্তি বস্তা ফেলা শুরু করা হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর