বৃহস্পতিবার, ৯ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

সবুজ পাহাড়ে কারণ ছাড়াই অঙ্কুরিত হয় অশান্তির বীজ

বান্দরবান প্রতিনিধি

আবারও সন্ত্রাসীদের আধিপত্যের লড়াইয়ে রক্তাক্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম। সবুজ পাহাড়ে অশান্তির বীজ যেন কিছুদিন পরপরই অঙ্কুরিত হয়ে উঠছে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে সিনেমাটিকভাবে ঘটছে হত্যাকান্ড। হামলার পর পড়ে থাকে লাশ আর লাশ। সর্বশেষ মঙ্গলবার বান্দরবানে ঝরল ছয় তাজা প্রাণ। জেএসএস সন্তু লারমার অনুসারীদের ব্রাশফায়ারে সংস্কারপন্থি ছয় শীর্ষ নেতার মৃত্যুর পর আবারও রক্তক্ষয়ী সংঘাতের আশঙ্কায় ভীত স্থানীয়রা। নতুন করে আধিপত্য বিস্তারে সংস্কারপন্থিরা যেমন রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি থেকে অনুসারীদের বান্দরবানে জড়ো করছেন, তেমন তাদের প্রতিহত করতে সশস্ত্র অবস্থানে রয়েছেন সন্তু লারমার অনুসারীরা।

পাহাড়ে বর্তমানে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের চারটি সশস্ত্র সংগঠন। এগুলো জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), জনসংহতি সমিতি (জেএসএস-এম এন লারমা), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর গোয়েন্দা তথ্যানুযায়ী এসব আঞ্চলিক সংগঠনের কাছে ছোট অস্ত্রের পাশাপাশি অনেক ভারী অস্ত্র মজুদ রয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মঙ্গলবারের হামলায়ও ব্যবহার করা হয় অত্যাধুনিক অস্ত্র।

আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজির এলাকা নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র করে পাহাড়ি সংগঠনগুলো সংঘাতে জড়াচ্ছে। এদিকে ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত সাত বছরে পাহাড়ে সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে ৮৬১টি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সশস্ত্র গ্রুপগুলোর কাছে রয়েছে- এলএমজি ১৪৪টি, এসএমজি ও একে-৪৭, সেভেন পয়েন্ট ৬২ মিমি রাইফেল ৩২৩টি, এম-১৬ রাইফেল ১২২টি, জি-৩ রাইফেল ৫৯টি, জিরো পয়েন্ট ২২ রাইফেল ৮৫টি, স্নাইপার রাইফেল ৫টি, দেশি-বিদেশি পিস্তল ৩৬০টি, মর্টার ৪০টি, দেশি-বিদেশি বন্দুক প্রায় ৩০০, দেড় হাজারের মতো হ্যান্ড গ্রেনেড ও অর্ধশতাধিক রকেট লঞ্চার। এদিকে পাহাড়ে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘাতে নিহতের ঘটনায় কখনো বিচার হয় না। এমনকি মামলাও না। সন্ত্রাসীদের ব্রাশফায়ারে নিহত জেএসএস (এম এন লারমা গ্রুপ)-এর বান্দরবান জেলা সভাপতি রতন তঞ্চঙ্গ্যার মেয়ে ডকি চিং মার্মা বুঝে গেছেন বাবার হত্যার বিচার চেয়ে কোনো লাভ হবে না। বরং সন্ত্রাসীদের হাত থেকে জীবন বাঁচানোই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। এদিকে জেএসএস সন্তু লারমার অনুসারীরা ফের হামলা চালাতে পারেন আশঙ্কায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন এম এন লারমা গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক উবামু মার্মা। নিহত রতন তঞ্চঙ্গ্যার স্ত্রী মেনী মার্মা বলেন, ‘আমার স্বামী তো মারা গেছেন। এখন আমি কীভাবে বাঁচব, কীভাবে থাকব তা নিয়েই চিন্তিত।’ জেএসএস গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক উবামু মার্মা বলেন, ‘আমাদের জনসমর্থন এবং আমাদের প্রতি জনগণের যে আস্থা তা তারা মানতে পারেনি। তাই আমাদের ওপর হামলা করা হয়েছে।’ কয়েক বছর আগেও বান্দরবানে পাহাড়ের আঞ্চলিক দলগুলোর অনুসারী সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর তেমন তৎপরতা ছিল না। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে জেএসএস সন্তু লারমা, জেএসএস সংস্কারপন্থি এম এন লারমা গ্রুপ, ইউপিডিএফ ও ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক গ্রুপের সদস্যরা আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ‘মগ পার্টি’ নামে আরও একটি সন্ত্রাসী বাহিনী। বান্দরবান সদর থানার অফিসার ইনচার্জ শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘নিজের এলাকা ছেড়ে যখন অন্য এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে তখনই বেধে যায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। এ বিষয়গুলো আমরা তদন্ত করে দেখেছি।’ স্থানীয়দের মতে, আঞ্চলিক দলগুলো বান্দরবানে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে বাকি দুই পার্বত্য জেলা রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি থেকে নিজেদের অনুসারীদের নিয়ে আসছে। ব্রাশফায়ারে নিহত রতন তঞ্চঙ্গ্যা যেমন খাগড়াছড়ি থেকে পাঁচ শীর্ষ নেতাকে তার বাসায় এনে রেখেছিলেন। আর টার্গেট এ ছয়জনকে হত্যা করতে রাঙামাটি থেকে এসেছিলেন সন্তু লারমার অনুসারীরা। বান্দরবান পৌরসভার মেয়র ইসলাম বেবী বলেন, ‘প্রতিনিয়ত অস্ত্রের এমন ঝনঝনানি দেখা যাচ্ছে। আমরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই যেন এর অবসান ঘটানো হয়। আমরা শান্তিপ্রিয় মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে চাই।’ ২০১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে গত তিন বছরে তিন পার্বত্য জেলায় পাহাড়ি সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে মারা গেছেন ৮৭ জন। এর মধ্যে বান্দরবানে গত দুই বছরে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। স্বজনদের লাশের জন্য লাশবাহী গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা, এটি রাঙামাটি কিংবা খাগড়াছড়িতে এখন প্রতিদিনের ঘটনা। কিন্তু বান্দরবানে এমন দৃশ্য খুব কমই দেখা যায়। তবে একসময়ের শান্ত বান্দরবানও এখন অশান্ত হয়ে উঠছে। এর মূল কারণ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর আধিপত্য বিস্তারে হানাহানি।

সর্বশেষ খবর