শনিবার, ১১ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনায় থামেনি বিয়ে কমেছে বিচ্ছেদ

জনসমাগম এড়াতে ও নিকাহ নিবন্ধন বন্ধ থাকায় কম বিয়ে, বোঝাপড়া করে বিচ্ছেদ ঠেকাচ্ছে স্বামী-স্ত্রী

জিন্নাতুন নূর

রাজধানীর পাশেই আমিনবাজার এলাকায় গত ১০ এপ্রিল সরকারি নির্দেশ অমান্য করে বিয়ের আয়োজন করায় বর-কনে পক্ষকে ৮০ হাজার টাকা জরিমানা করেন র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের সদস্যরা। কারণ করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে দেশে যে কোনো ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান ও জমায়েতের ওপর সরকার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এর আগে গত ৮ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলায় একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তার বিয়ের আয়োজন করা হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত হাজির হলে বর পালিয়ে যায়। বরের ভাইকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। মহামারীতে দেশে সব ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ থাকলেও কেউ কেউ লুকিয়ে নিষেধাজ্ঞা ভেঙে বিয়ে করে শাস্তির মুখোমুখি হচ্ছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ বছর যে তরুণ-তরুণীদের বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কথা ছিল মহামারীর কারণে তাদের অনেকে বিয়ের তারিখ পিছিয়ে দিয়েছে। হাতেগোনা কয়েকজন আবার ঘরোয়া পরিবেশে নিকট আত্মীয়দের উপস্থিতি বিয়ে করছেন।

সরকারের নির্দেশে গত মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে প্রাপ্ত বয়স্কদের বিয়ের অনুষ্ঠান বন্ধ থাকায় বর্তমানে দেশের নিকাহ রেজিস্ট্রাররা (কাজী) কিছুটা অলস সময় কাটাচ্ছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়,  রাজধানীর একটি ওয়ার্ডের কাজী অফিসে করোনা সংক্রমণের আগে প্রতি মাসে গড়ে ৩০-৪০টি বিয়ে পড়ানো হতো। মহামারীর কারণে সরকারি সব অফিস-আদালত বন্ধের পাশাপাশি সব ধরনের নিকাহ ও তালাক রেজিস্ট্রি (নিবন্ধন) বন্ধ রাখা হয়। এতে বিয়ের হার কমে এলেও তা একবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে ভাটারা খিলবাড়িরটেক কাজী অফিসের কাজী মো. মুজিবুর রহমান বলেন, করোনার কারণে বর্তমানে কমিউনিটি সেন্টার ও রেস্টুরেন্টগুলোতে বিয়ের অনুষ্ঠান বন্ধ আছে। তবে ঘরোয়া বিয়ের আয়োজনে অনেকেই নিয়ে যেতে চান। আমরা সেখানে যেতে মানা করি এবং এ মহামারীর সময় বিয়ের আয়োজন নিরুৎসাহিত করি। তিনি জানান, লকডাউনের পর গত ৩১ মে থেকে সীমিত আকারে বিয়ে পড়ানোর  কার্যক্রম আবার শুরু হয়েছে। অন্যদিকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিবাহ বিচ্ছেদের হার আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পেলেও দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর থেকে বিচ্ছেদের হারও কমে গেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, গত কয়েক মাস তালাক রেজিস্ট্রি বন্ধ রাখার কারণসহ বর্তমান পরিস্থিতিতে সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপের কারণে বিচ্ছেদের হার কমে যায়। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারিতে বিচ্ছেদের হার বেশি থাকলেও ধীরে ধীরে এ সংখ্যা কমে আসে। জানুয়ারিতে উত্তর সিটি করপোরেশনে ৬১৮ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৪৪১ জন, মার্চে ৪৫৫ জন বিচ্ছেদের আবেদন করেন। সাধারণ ছুটির কারণে এপ্রিলে কোনো আবেদন করা হয়নি। মে মাসে ৫৪টি এবং জুন মাসে জনজীবন কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এ সংখ্যা কিছুটা বৃদ্ধি পেয়ে ৬৩২ জনে দাঁড়ায়। একইভাবে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৫২৮ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৪৪২ জন, মার্চে ৪৯২ জন বিচ্ছেদের আবেদন করেন। উত্তরের মতো দক্ষিণেও এপ্রিল মাসে বিচ্ছেদের কোনো আবেদন করা হয়নি। তবে মে মাসে ১১৩ জন ও জুনে ৪৪১ জন বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করেন। উত্তর ও দক্ষিণে আবেদনকৃত নারী-পুরুষের মধ্যে নারীরা পুরুষের চেয়ে দ্বিগুণ হারে বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করেন। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, নারীদের বিচ্ছেদে যাওয়ার আগে তার নিজের থাকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হয়। আর সন্তান থাকলে সেই নারীর চিন্তা আরও বেশি। আবার করোনা সংক্রমণের কারণে আগে থেকেই মানসিক চাপ থাকায় মেয়েটির অভিভাবকরা এ সময় তাকে গ্রহণ করবে কিনা মেয়েটি সে ব্যাপারেও নিশ্চিত নয়। বিচ্ছেদে যেতে হলে নারীর অর্থনৈতিক অবলম্বন বেশি প্রয়োজন আর নারীরা আগের চেয়ে বেশি কাজও করছে। কিন্তু মহামারীতে অনেক মেয়ে চাকরি হারিয়েছে। এক্ষেত্রে অনেকেই নিজের আত্মসম্মান রক্ষায় সচেতন হয়ে স্বামীর সঙ্গে আপস করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মহামারীতে দেশে বিবাহ বিচ্ছেদের হার কমে যাওয়ার পরিসংখ্যনটি বেশ ‘ইন্টারেস্টিং’। তার মতে, এর মাধ্যমে  পারিবারিক সম্পর্কগুলো বিশ্লেষণ করা সম্ভব। তিনি বলেন, যেহেতু এটি সংক্রমণের মহামারী, এজন্য যেসব স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দ্বন্দ¦ ছিল তারা এ সময়ে বিষয়টি মেনে নিয়েই একসঙ্গে থাকতে বাধ্য হয়েছেন। যেহেতু এ পরিস্থিতিতে কিছু করার নেই এ জন্য স্বামী-স্ত্রীরা একে অন্যের সঙ্গে বোঝাপোড়ার মাধ্যমে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তবে এ মানিয়ে নেওয়াকে দীর্ঘস্থায়ী বলা না গেলেও মধ্যস্থতার মধ্যদিয়ে যদি কোনো সম্পর্ক নতুন করে শুরু করা যায় তবে সেটি ইতিবাচক বিষয়।

সর্বশেষ খবর