রবিবার, ১২ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

দ্রুত বাড়ছে নদ নদীর পানি

ফের বন্যায় ডুবছে দেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

দ্রুত বাড়ছে নদ নদীর পানি

তিস্তার বাঁধ ভেঙে রংপুর জেলার গঙ্গাচড়ার লক্ষ্মীটারি ইউনিয়নের বিনবিনাচর পানিতে তলিয়ে গেছে -বাংলাদেশ প্রতিদিন

ভারি বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে দেশের বন্যা পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে যাচ্ছে। এরই মধ্যে সুনামগঞ্জ, সিলেট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, রংপুর, সিরাজগঞ্জ, লালমনিরহাট, নওগাঁসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোর নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে। স্রোতে ভেসে গেছে ঘরবাড়ি, গবাদি পশু। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে অনেক এলাকার যোগাযোগব্যবস্থা। বন্যার পর সপ্তাহ না পেরোতেই ফের পানিবন্দী লাখো মানুষ। দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রায় সব নদ-নদীর পানি। গতকাল সকাল ৯টা নাগাদ সাতটি পানিসমতল স্টেশনে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল ছয়টি নদীর পানি। আজকের মধ্যে আরও সাত-আটটি পয়েন্টে নদ-নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করার পূর্বাভাস দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। এতে প্লাবিত হতে পারে নতুন নতুন এলাকা। পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী সুরমা, ধরলা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র তিস্তা, গুড়, যদুকাটা, করতোয়া, আত্রাই, ধলেশ্বরী, তুরাগ, পুনর্ভবা, পদ্মা, ইছামতি, মাথাভাঙা, পশর, কুশিয়ারা, খোয়াই, সোমেশ্বরী, মেঘনা, মুহুরী, সাঙ্গুসহ দেশের অধিকাংশ নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে দ্রুত গতিতে। গতকাল সকাল নাগাদ ১০১টি পানিসমতল স্টেশনের ৬৬টিতে পানি বৃদ্ধি পায়। সাতটি পয়েন্টে বিদৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল তিস্তা, যমুনা, সুরমা, সারিগোয়াইন, যদুকাটা ও গুড় নদের পানি। বিকালের মধ্যে নতুন করে বেশকিছু পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করে পানি।

পাউবোর গতকালের তথ্যানুযায়ী ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আপার মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদ-নদীগুলোর পানিসমতল অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আগামী তিন দিন তা অব্যাহত থাকতে পারে। পদ্মার পানি স্থিতিশীল থাকলেও ২৪ ঘণ্টায় বাড়তে পারে। এ ছাড়া ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র নদ নুনখাওয়া ও চিলমারী পয়েন্টে, যমুনা নদী বাহাদুরাবাদ, সারিয়াকান্দি ও কাজিপুর পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। তিস্তা ও ধরলার পানিসমতল বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। এ ছাড়া ২৪ ঘণ্টায় মেঘনা অববাহিকার সুরমা নদী সিলেট পয়েন্টে, পুরাতন সুরমা নদী দেরাই পয়েন্টে, সোমেশ্বরী নদী দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, নাটোর, সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার নিম্নাঞ্চলে।

আমাদের বিভিন্ন জেলার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন বন্যার সর্বশেষ পরিস্থিতি- রংপুর : ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে গতকাল সকালে দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে নদীর পানি আরও বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ২৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তিস্তা ব্যারাজের সবকটি জলকপাট খুলে দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। গঙ্গাচড়ায় পানির স্রোতে ৯০টি পরিবারের ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। এ ছাড়া কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলায় অর্ধশত বসতভিটা নদীগর্ভে হারিয়ে গেছে। চরাঞ্চল তলিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তিস্তার পানি বৃদ্ধিতে গঙ্গাচড়ার বিস্তৃত এলাকা তলিয়ে গেছে। এসব এলাকার প্রায় ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। কাউনিয়া উপজেলার আটটি ও পীরগাছা উপজেলার ১০টি গ্রাম তলিয়ে গেছে। হঠাৎ আসা পানিতে বাঁধ ছুঁইছুঁই করছে। রাস্তাঘাট তলিয়ে চরাঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। অনেকের ঘরে হাঁটু কিংবা কোমর পানি। সিরাজগঞ্জ : শুক্রবার ফের যমুনার পানি বাড়তে শুরু করেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে ১২ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ভাঙনে নির্ঘুম রাত কাটছে নদীতীরবর্তী মানুষের। নতুন করে পানি বাড়ায় জেলার ৩৩টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের ২১৬টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ফের ডুবছে জমির ফসল। ভবিষ্যৎ নিয়ে আতঙ্কিত কৃষক। করোনার মধ্যে একের পর এক বন্যায় তীব্র খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। বানভাসিদের অভিযোগ, কষ্টে থাকলেও জনপ্রতিনিধিদের কেউ খোঁজ নিচ্ছেন না। সরকারি সহায়তা অধিকাংশ মানুষের ঘরে পৌঁছেনি। লালমনিরহাট : তিস্তা ও ধরলার পানি আবারও বৃদ্ধি পেয়ে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। তিস্তা-ধরলার তীরবর্তী ও চরাঞ্চলের অর্ধলক্ষাধিক মানুষ আবারও পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। তিস্তা-ধরলার ৬৩টি চরের রাস্তাঘাট ধসে গিয়ে যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এসব এলাকায় দেখা দিয়েছে চরম খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট। পানিবাহিত নানা রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। অব্যাহত পানি বাড়ায় চর এলাকার লোকজনকে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। গতকাল সকাল ৯টায় তিস্তার ডালিয়া পয়েন্টে পানিপ্রবাহ বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। চলতি বন্যায় তিস্তার এটাই সর্বোচ্চ পানিপ্রবাহের রেকর্ড। নীলফামারী : গতকাল দুপুরে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ২৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও বিকালে ডালিয়া পয়েন্টে ২৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। জনপ্রতিনিধিদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী পানিবন্দী হয়ে পড়েছে উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নের ৬ হাজার ৫০০ পরিবারের প্রায় ২৫ হাজার মানুষ। কয়েক শ পরিবার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। সুনামগঞ্জ: সুনামগঞ্জে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় দ্বিতীয় দিনের মতো বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। গতকাল সকালে সুরমার পানি সুনামঞ্জের ষোলঘর পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫৪ সেন্টিমিটার ও যদুকাটার পানি শক্তিয়ারখলা পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৩৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। প্রশাসন জানিয়েছে, বন্যায় জেলার ৮৭ ইউনিয়নের মধ্যে ৮৩ ও চার পৌরসভার ১৮ ওয়ার্ড প্লাবিত হয়েছে। চলাচলের রাস্তা তলিয়ে যাওয়ায় জেলা সদরের সঙ্গে তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, ছাতক, দোয়ারাবাজার ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। চরম ভোগান্তিতে এলাকার মানুষ। কুড়িগ্রাম : তিস্তা, ধরলা, ব্রহ্মপুত্রসহ ১৬টি নদ-নদীর পানি আবারও দ্রুত বাড়ছে। দ্বিতীয় দফা বন্যার কবলে পড়তে যাচ্ছে উত্তরাঞ্চলসহ কুড়িগ্রাম জেলা। গতকাল বিকাল ৩টায় কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় তিস্তার পানি কাউনিয়া পয়েন্টে অস্বাভাবিক বেড়ে বিপৎসীমার ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং ধরলার পানি বেড়ে বিপৎসীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সন্ধ্যার মধ্যেই ব্রহ্মপুত্র ও দুধকুমর নদের পানিও বিপৎসীমা অতিক্রম করবে এবং ধরলা ও তিস্তার পানি বিপৎসীমার অনেক ওপরে চলে যাবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। সিলেট : টানা বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে ঢল নামা অব্যাহত থাকায় সিলেটে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সিলেট সদর, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, কানাইঘাট ও জৈন্তাপুরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বিভিন্ন উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় ভেঙে পড়েছে যোগাযোগব্যবস্থা। গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় কুশিয়ারার পানি ফেঞ্চুগঞ্জ ও সুরমার পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সারিঘাট পয়েন্টে সারি নদীর পানিও প্রবাহিত হচ্ছে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে। শুক্রবার থেকে সুরমা, কুশিয়ারা, সারি ও লোভা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বন্যার পানি উঠেছে এলাকার ঘরবাড়ি, ব্যবসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট, মাছের খামার, খেতের ফসল ও বীজতলা। নওগাঁ : কয়েক দিনের ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে ছোট যমুনা ও আত্রাই নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় প্লাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চলগুলো। আত্রাইর পানি বৃদ্ধি পেয়ে কাসিয়াবাড়ী ব্রিজ দিয়ে প্রবেশ করে নওগাঁর রানীনগর উপজেলার বড়গাছা ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত করেছে। পুকুর ডুবে যাওয়ায় ভেসে গেছে মাছ। ডুবে গেছে আমনের বীজতলা।

সর্বশেষ খবর