বুধবার, ১৫ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

২০০ বছরের চট্টগ্রাম ফিশারি ঘাট

সামুদ্রিক ও মিঠা পানির মাছের পাইকারি বাজার

ফারুক তাহের, চট্টগ্রাম

২০০ বছরের চট্টগ্রাম ফিশারি ঘাট

দেশের সবচেয়ে বড় সামুদ্রিক ও মিঠা পানির মাছের পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের ফিশারি ঘাট। প্রায় ২০০ বছর আগে ফিরিঙ্গী বাজারে পর্তুগিজরা গোড়াপত্তন ঘটান এই মাছঘাটের। চট্টগ্রামে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন এবং বন্দরের শুল্ক আদায়ের অধিকার পেয়ে পর্তুগিজরা এখানে আড়ত স্থাপন করে। কালের পরিক্রমায় তা সরে যায় পাথরঘাটা ইকবাল রোডে। সর্বশেষ তিন বছর আগে স্থানান্তরিত হয়ে আরও বড় পরিসরে ফিশারি ঘাটটি অবস্থান নেয় লুসাই কন্যা কর্ণফুলী নদীর তীরে রাজাখালীর মুখে। যেখানে প্রতিদিন ভোররাত ৩টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত এই ৫ ঘণ্টায় মৌসুমভেদে ৫ থেকে ৫০ কোটি টাকার মাছ বেচাকেনা হয়। আড়তদারদের মতে- দেশের এমন কোনো জেলা নেই যেখান থেকে এই ঘাটে মাছ আসে না এবং যায় না। ফলে এই করোনাকালেও এখানে জনসমাগমের কমতি নেই। নেই সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার কিংবা স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো নিয়ম-নীতি। ঘাটের তীরে মাছ বোঝাই ট্রলার ভিড়লেই শুরু হয়ে যায় হাঁকডাক। এরপর একের পর মাছের টুকরি, প্লাস্টিকের বড় চৌবাচ্চা, প্যাকেটজাত সামুদ্রিক ট্রলিতে নামতে থাকে ঠেলাগাড়ি করে। এ সময় কথা বলারও ফুরসত মিলে না কারোই। পাইকারি দামে এই ফিশারি ঘাট থেকে মাছ সরবরাহ হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। অনেক ব্যবসায়ী বিদেশেও রপ্তানি করেন এসব মাছ। সারা দেশ থেকেই পাইকারি ব্যবসায়ীরা এই বাজারে আসেন। এখানে মিয়ানমার ও ভারত থেকেও মাছ আসে। আবার সাধারণ ক্রেতাদের হাতে সামুদ্রিক ও মিঠা পানির তাজা মাছ তুলে দিতে এখান থেকেই সংগ্রহ করেন বন্দরনগরীর খুচরা বিক্রেতারাও। চট্টগ্রামের নতুন এই ফিশারি ঘাটে আড়ত রয়েছে প্রায় ২২০টি। অপরদিকে পুরনো ফিশারি ঘাটে রয়েছে ৬৮টি আড়ত। তবে পুরনো বাজারের বেশিরভাগই এখন নতুন বাজারে আড়ত নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। এখানে পাওয়া যায় না, এমন কোনো মাছ নেই। সামুদ্রিক মাছের মধ্যে লাক্ষা, ইলিশ, কই কোরাল, দাতিনা কোরাল, রেড স্নাপার, ভেটকি, সুরমা, কাটল ফিশ, সুরমা, তাইলন্ডা, মাইট্টা, চেউয়া, চিড়িং, দেশি স্কুইড, রূপচাঁদা, ম্যাকারে, শ্রিম্প, টুনা, স্যামন, ম্যাকরেল, সারডিন, স্কুইড, লবস্টার, টুনা কড, ছুরি, পোপা, ফাইস্যা, লইট্যা, দেশীয় সব প্রজাতির চিংড়ি, চাপা, চাপিলা ও রিকসা মাছ উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে মিঠা পানির মাছের মধ্যে পুকুর-খামার থেকে সংগ্রহ করা রুই, কাতলা, বোয়াল, কই, মাগুর, শিং, তেলাপিয়া, কাচকি, বাইলা, বাইম, মইল্লা, পুঁটি মাছও পাওয়া যায়। ফলে এখানে পাইকারদের পাশাপাশি মোটর গাড়ি নিয়ে প্রতিদিন ভোরে হাজির হন অনেক শৌখিন মাছ ক্রেতারাও। অনেকে পুরো মাসের চাহিদামতো পছন্দের মাছ কিনতে ছুটে যান ফিশারি ঘাটে। সরেজমিন জানা যায়, সোমবার যথারীতি ক্রেতা-বিক্রেতারা জড়ো হন ভোরের আলো ফোটার অনেক আগেই। এরপর জড়ো হতে থাকেন মাছশ্রমিক, মুটে, চাওয়ালা, পানওয়ালা এবং বাজারের ব্যাগওয়ালা। সামুদ্রিক মাছ ধরার ক্ষেত্রে বর্তমানে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা চলছে। আগামী ২৪ জুলাই সরকারি সেই নিষেধাজ্ঞা ওঠে যাচ্ছে। এরপর থেকেই শুরু হবে পুরোদমে ইলিশ ধরার মৌসুম। বছরের এই সময়টাতেই বেশি পরিমাণ লেনদেন হয় আড়তগুলোতে। তবে মাছের পরিমাণ স্বল্পতা থাকলেও সোমবার ক্রেতা-বিক্রেতাদের উপস্থিতি কম ছিল না ফিশারি ঘাটে। দুই সপ্তাহ পরেই নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে দ্রুত মাছ ধরার জন্য সমুদ্রে পাড়ি দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে ঘাটে নোঙর করা কয়েকশ ট্রলারের মাঝি-মাল্লার। আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চারটি জেটি আছে এই ঘাটে। একটি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন পরিচালনা করে, বাকি তিনটি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) লিজ দিয়েছে। ট্রলারগুলোকে প্রতি ট্রিপে ২০০ টাকা এবং বিক্রি হওয়া মাছের ২ শতাংশ দিতে হয় চউককে। এই বাজারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বরফকল ও কোল্ড স্টোরেজ। খাবারের হোটেলও আছে কয়েকটি। প্রায় অর্ধলাখ মানুষের জীবিকা জড়িয়ে আছে এই বাজারের সঙ্গে। চট্টগ্রামের প্রায় ১০ হাজার ফিশিং বোট ও কয়েকশ ট্রলারের আহরিত মাছ বিক্রি হয় এই বাজারে। ফিশারি ঘাটের স্টার ফিশ আড়তের অংশীধার মোহাম্মদ রাজু ও মোহাম্মদ রুবেল জানান, কোনো কোনো আড়তদার শুস্ক মৌসুমে দেশের উপকূলীয় প্রান্তিক জেলেদের হাতে অগ্রীম লাখ লাখ টাকাও দিয়ে থাকেন, ইলিশ মৌসুমে যেন তাদের আড়তেই মাছ বিক্রি করে জেলেরা। তবে এ ধরনের লেনদেন আগে বেশি হতো, এখন অনেক কমে গেছে। কয়েক বছর ইলিশ মাছ বেশি ধরা পড়াতে প্রান্তিক জেলেদের হাতেও এখন মোটামুটি ভালো টাকা আছে বলে জানালেন এ দুজন মাছ ব্যবসায়ী।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর