বুধবার, ১৫ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনায় জমজমাট ই-কমার্স

প্রায় ১২০০ প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোক্তার সঙ্গে চার লাখ নারী ফেসবুকে পণ্য বিক্রিতে সক্রিয়, চলতি বছর ২ বিলিয়ন ছাড়াবে ই-কমার্সের বাজার

রুহুল আমিন রাসেল

করোনায় জমজমাট ই-কমার্স

করোনাকালে দেশে স্থানীয় ক্রেতারা এখন অনলাইনমুখী। ফলে জমজমাট ই-কমার্স। বাড়ছে কেনাকাটা। লেনদেনও বাড়ছে বহুগুণে। জানা গেছে, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় এখন অনলাইনে বিক্রি বেড়েছে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ। এ খাতে প্রায় ১ হাজার ২০০ প্রতিষ্ঠানে লাখো মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। আবার চার লাখ নারী উদ্যোক্তা ফেসবুকে পণ্য বিক্রিতে সক্রিয়। দ্রুতগতিতে হচ্ছে ব্যবসা সম্প্রসারণ। ফলে বাংলাদেশে ই-কমার্সের বাজার দেড় বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। যা চলতি বছর দুই বিলিয়ন ও ২০২৩ সালে তিন বিলিয়ন ডলার ছাড়ানোর তথ্য দিয়েছে জার্মান ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টা। এ প্রসঙ্গে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি-আইসিটি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকারের দেওয়া বেশ কিছু নীতি সহায়তার ফলেই এখন সাফল্যের মুখ দেখছে ই-কমার্স। শত শত উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রায় চার লাখ নারী উদ্যোক্তাও ফেসবুকে পণ্য বিক্রি করছেন। এক্ষেত্রে পণ্য ডেলিভারিকেও সরকারি জরুরি সেবা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এমনকি করোনাকালে এবার কোরবানির ঈদ সামনে রেখে আমরা পশুর হাটকে ডিজিটাল প্লাটফর্মে আনছি। এই সময়ে অনলাইনের ব্যবহার ৫০ শতাংশ বেড়েছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ৫ বছরে ই-কমার্সে ৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলেও মনে করেন প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।

ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা ই-ক্যাব সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহেদ তমাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ব্যবসা এখন অনেক ভালো চলছে। এক কথায় করোনাকালে ই-কমার্সে বিপ্লব হয়ে গেছে। অনলাইনে বিক্রির প্রবৃদ্ধি আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ বেড়েছে। তবে সব ধরনের পণ্য ক্রেতারা এখনো কিনছেন না। জরুরি প্রয়োজনীয় পণ্যই বেশি কিনছেন তারা। সারা দেশে ই-কমার্স বা অনলাইন কেনাকাটার বাজার প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে বলেও জানান তিনি।

জানা গেছে, শপিং মল বা রেস্তোরাঁয় বড় জমায়েতের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় মানুষ এখন ঘরে বসেই অনলাইনে অর্ডার করছেন পছন্দের পণ্য। ওষুধ, পোশাক, খাদ্যদ্রব্যসহ সব ধরনের পণ্য কেনাকাটা করছেন অনলাইন প্লাটফর্ম থেকে। দরিদ্র কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্তরা বাজারমুখী হলেও মধ্যবিত্ত কিংবা উচ্চবিত্তরা অনলাইনে কেনাকাটা করছেন বেশি। বিক্রি বাড়ায় খুশি ব্যবসায়ীরা। সন্তুষ্ট ক্রেতারাও। ব্যবসার পরিধি বাড়ানো ও ক্রেতা ধরে রাখতে ব্যবসায়ীরা নিত্যনতুন ছাড় দিচ্ছেন। অনলাইনে পোশাক, গহনা, খাবার, ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী, কসমেটিক্স, সবজিসহ সব কিছুই মিলছে। ই-ক্যাবের তথ্যমতে, ক্রেতারা মূলত শহরকেন্দ্রিক। ই-কমার্সের ৮০ শতাংশ ক্রেতার ঢাকা, গাজীপুর ও চট্টগ্রামের। এদের মধ্যে ৩৫ শতাংশ ঢাকার, ৩৯ শতাংশ চট্টগ্রামের এবং ১৫ শতাংশ গাজীপুরের। অন্য দুটি শহর হলো- নারায়ণগঞ্জ ও সিলেট। ৭৫ শতাংশ ই-কমার্স ব্যবহারকারীর বয়স ১৮-৩৪-এর মধ্যে। দেশে ই-কমার্স খাতের বিকাশের চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে- ই-কমার্স সহায়ক উপযুক্ত জাতীয় নীতিমালা, ই-কমার্স উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ, আর্থিক লেনদেনের নিরাপত্তা, ধীরগতিসম্পন্ন ও ব্যয়বহুল ইন্টারনেট, ডেলিভারি চ্যানেল, ইন্টার-অপারেবল অবকাঠামো, দক্ষ ই-কমার্স প্রযুক্তি সহায়ক প্রশাসন ও মানবসম্পদের অভাব। আরও চ্যালেঞ্জ হলো- আস্থাশীল ই-কমার্স পরিবেশের অভাব, অনলাইনে কেনাকাটায় জনসাধারণের অভ্যস্ততার অভাব ও ভীতি। ভোক্তা অসন্তোষ নিরসনের সুনির্দিষ্ট মেকানিজমের অভাব। ই-কমার্স খাতে ব্যাংকিং সুবিধা প্রদানে অনীহা। ই-কমার্স খাতের বিকাশে কোনো প্রণোদনা প্যাকেজ না থাকা এবং পর্যাপ্ত প্রচারণার অভাব ইত্যাদি। এমন প্রেক্ষাপটেই ই-কমার্সের বিশ্বে বাংলাদেশ ৪৬তম অবস্থানে থাকার তথ্য দিয়েছে জার্মান গবেষণা সংস্থা স্ট্যাটিস্টা। এ প্রসঙ্গে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ- ই-ক্যাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রাজিব আহমেদ সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ই-কমার্সের বাজার বিলিয়ন ডলার ছাড়ানোর মধ্য দিয়ে এখন ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল। তবে চ্যালেঞ্জ হলো- গ্রামে গ্রামে পণ্য ডেলিভারি। এই খাতে ৯০ শতাংশ পণ্য ক্যাশ অন ডেলিভারি বা নগদে হওয়ায় টাকা মেরে দেওয়ার ঘটনা খুবই কম। তবে বিদেশি পণ্য এনে দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রি-অর্ডারের নামে কিছু প্রতারণা হচ্ছে। এক্ষেত্রে ক্রেতাদের সতর্কতাও জরুরি। স্ট্যাটিস্টার সর্বশেষ তথ্যমতে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশের ই-কমার্সের বাজার দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬৪৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা চলতি বছর বেড়ে হবে ২ হাজার ৭৭ মিলিয়ন ডলার। আর আগামী ২০২৩ সালে বাজারের আকার হবে ৩ হাজার ৭৭ মিলিয়ন ডলার।

ই-ক্যাব সূত্র জানায়, বাংলাদেশে গত তিন বছর ধরে এই খাতের প্রবৃদ্ধি প্রায় একশ ভাগ। অর্থাৎ প্রতি বছর প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে এই খাত। বাংলাদেশে ই-কমার্সের এক নম্বর জায়গাটি এরই মধ্যে চীনের আলিবাবার দখলে। বাংলাদেশ নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আমাজনও। আর সম্প্রতি এই বাজারে ঢুকেছে পূর্ব ইউরোপের আরেকটি বড় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কিউভি। বড় বড় বিদেশি কোম্পানিগুলো হঠাৎ আগ্রহী হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ নিয়ে। কারণ এই খাতে মাসে এখন প্রায় সাতশ কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে। অর্থাৎ বার্ষিক লেনদেন এখন আট হাজার কোটি টাকার বেশি। জানা গেছে, বাংলাদেশে এই মুহূর্তে প্রায় ১ হাজার ২০০ মতো প্রতিষ্ঠান ই-কমার্সের সঙ্গে যুক্ত। আলিবাবা ইতিমধ্যে বাংলাদেশের ই-কমার্সে ঢুকে পড়েছে ‘দারাজ’ কিনে নেওয়ার মাধ্যমে। সব ধরনের পণ্যই এখন বাংলাদেশে অনলাইনে কেনা-বেচা হয়।

তবে উন্নত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের ই-কমার্স এখনো একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে। অনলাইনে অর্ডার দেওয়া গেলেও এখনো নগদ অর্থেই লেনদেন বেশি। এটাকে বলা হয় ক্যাশ অন ডেলিভারি। অর্ডার অনলাইনে দেওয়া হলেও কল সেন্টার থেকে ফোন করে সেটি আবার নিশ্চিত করা হয়। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান পণ্য কাস্টমারের কাছে পৌঁছে দিয়ে নগদ টাকায় নিয়ে আসে। কাজেই পূর্ণাঙ্গ ই-কমার্স বাংলাদেশে এখনো সেভাবে চালু হয়নি। জানা গেছে, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান হচ্ছে দারাজ। দারাজ শতভাগ বিদেশি বিনিয়োগে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান। ই-কমার্সে এর পরে যারা আছে, তারা সবাই বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান। যেমন আজকের ডিল, বাগডুম, প্রিয় শপ, রকমারি, পিকাবু এবং অথবা। পূর্ব ইউরোপের একটি বড় ই-কমার্স কোম্পানি সম্প্রতি বাংলাদেশে ঢুকেছে। এর নাম কিউভি। এরা বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে। আমাজন বাংলাদেশে আসার জন্য বেশ সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু সরাসরি হয়তো বাংলাদেশের বাজারে এখনই ঢুকছে না। জানা গেছে, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অনলাইনের প্রচার ও প্রসার বাড়ায় এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে ভুয়া অনলাইন পেজ খুলে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে কিছু চক্র।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর