শুক্রবার, ২৪ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনায় জীবনধারায় ছন্দপতন

ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে সামাজিক সম্পর্ক, তৈরি হচ্ছে অস্থিরতা

জিন্নাতুন নূর

করোনায় জীবনধারায় ছন্দপতন

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে ছন্দপতন ঘটেছে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনে। সামাজিক অনুষ্ঠান, বেড়ানো ও আড্ডার মতো বিষয়গুলো দীর্ঘ সময় ধরে পুরোপুরি বন্ধ থাকায় দুর্বল হয়ে যাচ্ছে সামাজিক সম্পর্ক। তৈরি হচ্ছে মানসিক অস্থিরতা। মনের ভিতরের এ অস্থিরতার প্রভাব প্রকট হচ্ছে সমাজেও। করোনা মহামারী কেটে যাওয়ার আগে এ থেকে পরিত্রাণের উপায়ও দেখছেন না সমাজবিজ্ঞানীরা।

করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে গোটা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও মানুষ ভিড় এড়িয়ে চলছে। হচ্ছে না বিয়ের মতো সামাজিক অনুষ্ঠান। বন্ধ আছে সব ধরনের ক্লাব। খেলা নেই, তাই শূন্য পড়ে আছে স্টেডিয়াম। বড় বড় রেস্টুরেন্টের কয়েকটি সীমিত পরিসরে চালু হলেও গ্রাহক উপস্থিতি খুব কম। শিশুদের পার্কগুলোও অনেক দিন ধরে বন্ধ। ইনডোর বা আউটডোর কোথাও হচ্ছে না সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সিনেমা হলে নেই সিনেমাপ্রেমীদের আনাগোনা। টিএসসি, শাহবাগ, বেইলি রোড ও রবীন্দ্রসরোবরেও আগের মতো নেই মানুষের আড্ডা ও কোলাহল।

করোনা সংক্রমণের আগেও বন্ধুদের নিয়ে প্রতিদিন সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় আড্ডা দিতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ইমন আহমেদ। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে আগের সেই আড্ডা পাঁচ মাস ধরে বন্ধ আছে। ফেসবুকের মেসেঞ্জারেই এখন বন্ধুদের নিয়ে গ্রুপ আড্ডা দেন।

কয়েক মাস আগেও ঢাকার হাতির ঝিল, সংসদ ভবন, রবীন্দ্রসরোবরের মতো জায়গাগুলোয় প্রতিদিন বিকাল থেকে মানুষের আনাগোনা লেগেই থাকত। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ বন্ধু-বান্ধব ও প্রিয়জন নিয়ে এসব স্থানে আসত একটু ভালো সময় কাটানোর জন্য। অথচ লোকারণ্য হয়ে থাকা স্থানগুলোয় এখন আগের মতো সমাগম নেই। পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী আবদুল মালেকের সন্তানরা বাইরের খাবার খেতে খুব পছন্দ করে। ছুটির দিনে মালেককে অনেকটা নিয়ম করেই সন্তানদের নিয়ে যেতে হতো তাদের প্রিয় পিজ্জার দোকান বা ফুড কোর্টে। কিন্তু মহামারীতে নগরীর অনেক পিজ্জার দোকানে এখন আর বসে খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। ফলে অনলাইনে খাবার অর্ডার করেই সন্তানদের মন রাখার চেষ্টা করছেন মালেক। শিশুদের জন্য আগে থেকেই ঢাকায় বিনোদন পার্কের অভাব। করোনার আগে যা ছিল এখন তাও নেই। ফলে ঘরবন্দী শিশুরা ভিডিও গেম খেলে নয় তো ছাদে ঘুড়ি উড়িয়ে সময় কাটাচ্ছে। সেগুনবাগিচার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আবদুল মান্নান দুই দশক ধরে নিয়মিত ভোরবেলা নামাজ  পড়ে রমনা পার্কে হাঁটতে বের হতেন। কিন্তু বর্তমানে ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। বয়স্ক হওয়ায় পরিবারের সদস্যরাও তাঁকে বাইরে যেতে দিচ্ছেন না। হাঁটতে বের হয়ে খোশগল্পে মেতে ওঠা প্রবীণ এই নাগরিক এখন মোবাইল ফোনেই তাঁর হাঁটার সঙ্গীদের খোঁজখবর নিচ্ছেন। মহামারীতে সুনসান নাট্যপাড়াও। শিল্পকলা একাডেমিতে দীর্ঘদিন ধরে মঞ্চস্থ হচ্ছে না নাটক, থেমে আছে নাট্যচর্চাও। আবার সংগীতশিল্পীরাও কয়েক মাস ধরে কোনো অনুষ্ঠান বা কনসার্টে গান গাইছেন না। হাতে গোনা দু-এক জন অনলাইনে গান গাইলেও এতে দর্শকের মনের খোরাক সামান্যই মিটছে। পর্যটন কেন্দ্র বন্ধ থাকায় এবং যাতায়াতব্যবস্থার অসুবিধার কারণে ভ্রমণপ্রেমীরাও বিষণœ সময় কাটাচ্ছেন। আগে যারা মাসে দু-একটি ট্যুর না করে থাকতে পারতেন না তারাই এখন মাসের পর মাস বিনা ট্যুরে কাটিয়ে দিচ্ছেন। সেলুন ও পারলারগুলোও আগের মতো স্বাভাবিক নয়। সীমিত পরিসরে বিশেষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে সেলুন ও পারলারগুলো কাজ শুরু করলেও আগের মতো ভিড়ভাট্টা আর নেই। কেউ কেউ আবার সুরক্ষার কথা চিন্তা করে ঘরেই চুল-দাড়ি কেটে নিচ্ছেন। মহামারীতে সরকারি নিষেধাজ্ঞা অনুযায়ী জনসমাগম এড়াতে বিয়ের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানও বন্ধ আছে। মার্চ-এপ্রিলে যারা বিয়ে করার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন করোনার কারণে তা পিছিয়ে দিতে হয়েছে। আবার অনেকেই কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ে না করে ঘরোয়া পরিবেশে পরিবারের সীমিত সদস্যের উপস্থিতিতে বিয়ের কাজ সেরে নিচ্ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিন্নাত হুদা বলেন, ‘সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ সামাজিক জীবনধারার মধ্যে থাকতে পছন্দ করে। মানুষ মনস্তাত্ত্বিকভাবে কখনো একা জীবনযাপন করতে পারে না। আবার যেসব মানুষ একাকী থাকে তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায়।’ তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মধ্যে কয়েকটি শব্দ প্রবেশ করেছে। এর মধ্যে আছে- আইলোলেশন (বিচ্ছিন্ন থাকা), সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং (সামাজিক দূরত্ব)। করোনার মূল প্রতিপাদ্যই হচ্ছে দূরে দূরে থাকা। মহামারী থেকে বাঁচার জন্য আমরা এসব শব্দকে সামাজিক ও মানসিকভাবে গ্রহণও করেছি। অর্থাৎ পরিবার-পরিজন সমাজ থেকে কিছুটা হলেও বিচ্যুত জীবন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ কারণেই স্কুল, কলেজ, পার্ক, রেস্টুরেন্ট, রিসোর্ট ও সোশ্যাল গ্যাদারিং বন্ধ রেখেছি। অবশ্যই এর বড় ধরনের চাপ পড়ছে জীবনের ওপর। গৃহবন্দিত্ব সবার ওপরই মানসিক চাপ তৈরি করছে। পাশাপাশি সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করছে এবং সামাজিক সম্পর্কগুলোকে ওলটপালট করে দিচ্ছে।’ ড. জিন্নাত হুদা বলেন, ‘শিশুরা পাঁচ মাস ধরে স্কুলে যাচ্ছে না। স্কুলে গেলে সে বন্ধুবান্ধবের দেখা পায়। খেলাধুলার সুযোগ পায়। এখন এগুলো পাচ্ছে না। বদ্ধ পরিবেশে থাকতে থাকতে সে অনেকটাই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে, খারাপ আচরণ করছে।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর