বুধবার, ২৯ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

২০ মিনিটেই পথের ফকির

বন্যা ও ভাঙনে দিশাহারা মানুষ

নিজস্ব প্রতিবেদক

২০ মিনিটেই পথের ফকির

পদ্মার প্রবল স্রোতে গতকাল দুপুরে মাওয়া শিমুলিয়ায় বিআইডব্লিউটিএর তিন নম্বর ফেরিঘাট নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায় -রোহেত রাজীব

টানা মাসব্যাপী বন্যা আর নদীভাঙনে শিশু, বৃদ্ধ, গবাদি পশু নিয়ে সীমাহীন দুর্ভোগে লাখ লাখ মানুষ। আশ্রয় কেন্দ্র, উঁচু সড়ক ও বাঁধে আশ্রয় নিয়ে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগির সঙ্গে গাদাগাদি করে বসবাস করছেন বানভাসিরা। সংকট রয়েছে খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও ওষুধের। অন্যদিকে টানা বন্যায় ফসল নষ্ট হওয়ায় চরম দুশ্চিন্তায় কৃষক। মাছের ঘের ভেসে যাওয়ায় পথে বসেছেন অনেক মাছচাষি। পাশাপাশি নদী ভাঙনে ভিটেমাটি হারিয়ে রাতারাতি আমির থেকে পথের ফকির হয়ে গেছে অনেক পরিবার। মাত্র ২০ মিনিটে চোখের সামনে নদীগর্ভে চলে যেতে দেখেছেন পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া সম্পত্তি, তিল তিল করে গড়া নিজের ঘরবাড়ি। তারাও এখন পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন উঁচু  সড়ক ও বাঁধে। পথ চেয়ে আছেন সরকারি ত্রাণের জন্য। আমাদের সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, তিন দফা বন্যায় সিরাজগঞ্জ জেলার পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকে নদীভাঙনের শিকার হয় ঘরবাড়ি হারিয়ে পরিবার নিয়ে খোলা আকাশের নিচে ঝুপড়ি তুলে মানবেতর জীবন পার করছেন। সিমলা গ্রামের হারুন অর রশিদ তালুকদার এক সপ্তাহ আগেও ছিলেন এলাকার একজন সম্পদশালী ব্যক্তি। নিজ বাড়িতে ছিল ১২টি কাঁচাপাকা ঘর। ঘরভর্তি দামি আসবাব। গত শুক্রবার বিকালে হারুনের বাড়িঘর নদীতে বিলীন হয়ে যায়। শুধু পরনের লুঙ্গিটি নিয়ে তিনি ঘর থেকে বের হতে পারেন। মাত্র ২০ মিনিটের ব্যবধানে হারুন সবকিছু হারিয়ে পথের ফকির হয়ে যান। তার মতো ওই এলাকার আরও অন্তত ৫০ পরিবারের একই অবস্থা। হাজার হাজার মুরগিসহ বিলীন হয়ে গেছে খামার। এসব পরিবার এখন খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে। অপেক্ষায় থাকে কখন আসবে ত্রাণবাহী গাড়ি। এদিকে এখনো দেশের বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে বন্যাকবলিত এলাকাগুলো থেকে পানি নামতে পারছে না। অনেক নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সহসাই বন্যা থেকে মুক্তির সম্ভাবনা নেই। পানির চাপে বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন গ্রাম। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যমতে, এক দিনের ব্যবধানে গতকাল সকালেও ১০১টি পর্যবেক্ষণাধীন পানি সমতল স্টেশনের ৪৩টিতে পানি বৃদ্ধি পায়। ১৮টি নদীর পানি ২৯টি স্টেশনে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও আপার মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদীগুলোর পানি সমতল হ্রাস পেতে শুরু করলেও বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে তিস্তা, ধরলা ও ঢাকা জেলার আশপাশের নদীসমূহের পানি। আজ তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে বলে পাউবোর পূর্বাভাসে জানানো হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য- রাজবাড়ী : পদ্মা নদীর পানি বিপৎসীমার ১১৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার কারণে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ফেরিঘাটের দুটি ঘাটের সংযোগ সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। ফলে ঝুঁকি নিয়ে চলছে যানবাহন। দৌলতদিয়া প্রান্তের ছয়টি ঘাটের মধ্যে গত বছর নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত দুটি ঘাট গতকালও বন্ধ ছিল। শুধু ঘাট সংকটের কারণে ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা অপেক্ষা করে ফেরির নাগাল পেতে হচ্ছে যাত্রী ও চালকদের। এতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে যাত্রীদের। এ পরিস্থিতিতে গতকাল দৌলতদিয়া ফেরিঘাট পরিদর্শন করেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক। তিনি বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ওপর কারও হাত নেই। যত দ্রুত সম্ভব ঘাটগুলো সচল করা হবে। টাঙ্গাইল : যমুনা নদীর পানি ১০ সেন্টিমিটার কমার পরও গতকাল তা বিপৎসীমার ৭৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ঝিনাই ও ধলেশ্বরী নদীর পানি গতকালও বৃদ্ধি পায়। জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এতে প্রায় ছয় লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এখন পর্যন্ত জেলার ১১টি উপজেলার ৮৩টি ইউনিয়নের ৬৫২টি গ্রাম ও ছয়টি পৌর এলাকা প্লাবিত হয়েছে। নওগাঁ : আত্রাই নদীর উপচে পড়া পানিতে নওগাঁয় প্রায় ৬০০ বিঘা জমির পাট ডুবে গেছে। এতে ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েছে কৃষক। জানা গেছে, উপজেলার পারকাসুন্দা, খনজোর ও জয়সাড়াসহ বিভিন্ন মাঠে পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পাট পচে যাচ্ছে। যে মুহূর্তে কৃষকরা পাট কাটার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, সেই মুহূর্তে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের কয়েক স্থান ধসে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে আত্রাই নদীর দক্ষিণ পার জাতআমরুল নামক স্থানে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় আহসানগঞ্জ, পাঁচুপুর, বিশা ও কালিকাপুর ইউনিয়নের কৃষকরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। এসব ইউনিয়নের মাঠগুলোতে অন্যান্য ফসল তেমন না থাকলেও আউশ ধান এবং পাট ছিল অনেক বেশি। গাইবান্ধা : সব নদীর পানি কিছুটা কমলেও ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর পানি এখনো বিপৎসীমার অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। এক মাসের বেশি সময় ধরে বন্যার পানি আটকে থাকায় উপদ্রুত এলাকার জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। দিনমজুর এবং স্বল্প আয়ের লোকজন চরম দুর্দশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। যেসব পরিবার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও বিভিন্ন উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে তারা বাড়ি ফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। বিপাকে পড়েছে বন্যাকবলিত কর্মহীন পরিবারগুলো। বেসরকারি সংস্থাগুলো এখন পর্যন্ত কোনো ত্রাণ তৎপরতা শুরু করেনি। সরকারি ত্রাণ তৎপরতা অপ্রতুল বলে ভুক্তভোগী ও জনপ্রতিনিধিদের অভিযোগ রয়েছে। শরীয়তপুর : পদ্মা ও কীর্তিনাশা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। দিন দিন শরীয়তপুর জেলার বন্যার পরিস্থিতি অবনতি হচ্ছে। বন্যার পানিতে নতুন-নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। শরীয়তপুর জেলার শরীয়তপুর সদর, নড়িয়া, জাজিরা, ভেদরগঞ্জ, ডামুড্ডা উপজেলার অন্তত ৪২টি ইউনিয়ন বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। বন্যায় জেলার প্রায় ৩ লাখের ওপরে মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। দুর্গত এলাকায় চলছে ত্রাণের জন্য হাহাকার।

 গরু ছাগল উঁচুু রাস্তায় বেঁধে রাখা হয়েছে। মহাজনরা গরু চুরি হওয়ার আতঙ্কে রয়েছেন। এ ছাড়া ঢাকা-শরীয়তপুর মহাসড়কের ১৩ স্থান বন্যার পানিতে ডুবে থাকায় যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।

জামালপুর : যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি কিছুটা কমলেও উন্নতি হয়নি জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে পানিবন্দী অবস্থায় মানবেতর জীবন-যাপন করছে জেলার প্রায় ১০ লাখ মানুষ। বন্যা দুর্গত এলাকায় খাদ্য সংকটসহ ছড়িয়ে পড়ছে পানিবাহিত রোগ-বালাই। জেলা প্রশাসনের তথ্যানুযায়ী জামালপুর জেলার ৬৮টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫৯টি ইউনিয়ন ও ৮টি পৌরসভায় ৯ লাখ ৯৪ হাজার ৭০৭ জন পানিবন্দী রয়েছে। অপরদিকে পাঁচ হাজার ৯৭টি নলকূপ এবং ৬ হাজার ২৯৫টি টয়লেট তলিয়ে যাওয়ায় দুর্ভোগ চরমে উঠেছে।

কুড়িগ্রাম : সবকটি নদীর পানি কমায় উন্নতি হয়েছে বন্যা পরিস্থিতির। পানিবন্দী পরিবারগুলোর মধ্যে অনেকেই বাড়ি ফেরার চেষ্টা করছেন। করোনা পরবর্তী বন্যার্তদের মাঝে সরকারি সহায়তা অব্যাহত থাকলেও এনজিওরা হাত গুটিয়ে বসে আছে বলে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানিয়েছেন। এদিকে, পানিবন্দী থেকে কিছুটা মুক্তি মিললেও এখন ভাঙা বাড়িঘর ও সার্বিক ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে চিন্তিত বন্যার্তরা।

বগুড়া : তৃতীয় দফা বন্যার পানি গতকাল সকাল থেকে কমতে শুরু করেছে। পানি কমলেও বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। গতকাল পাউবো কর্মকর্তারা জানান, সারিয়াকান্দি উপজেলার মথুরাপাড়া পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি কমে এখন বিপৎসীমার ৯৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি কমার সংবাদে বানভাসিদের মাঝে কিছুটা স্বস্তির ভাব দেখা দিয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর