বুধবার, ২৯ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

হাটে গরু আছে বিক্রি কম

শফিকুল ইসলাম সোহাগ ও আলী আজম

হাটে গরু আছে বিক্রি কম

ঈদুল আজহা উপলক্ষে রাজধানীর পশুর হাটে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে গরু আসছে। বেচাবিক্রি এখনো জমে ওঠেনি। হাটে ক্রেতা কম। যারা হাটে আসছেন তারা ছোট ও মাঝারি সাইজের গরু দেখছেন। কেউ কিনছেনও। এবার ছোট গরুর চাহিদা বেশি। গরু কিনে খুশি ক্রেতারা। বিক্রেতারা ভালো দাম পাচ্ছেন না। করোনা এবং বন্যার দুর্যোগকে দায়ী করছেন গরু ব্যবসায়ীরা। গতবারের মতো এবারও পশুর দাম হাঁকাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এরই মধ্যে অনলাইনে পশু কেনাবেচাও বেশ জমে উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও পিছিয়ে নেই। করোনা সংক্রমণ রোধে ই-কমার্স অব বাংলাদেশের (ইক্যাব) সহায়তায় অনলাইনে   কোরবানির পশু কিনে অনলাইনের মাধ্যমে কোরবানি, মাংস প্রক্রিয়াকরণ এবং বাসায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছে সিটি করপোরেশন। সেখান থেকেই যাচাই-বাছাই করে গরু কিনছেন ক্রেতারা। তাই অনলাইনে পশুর হাট জমজমাট। পাঁচ দিনব্যাপী স্থায়ী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ১৭টি হাটে সারা দেশ থেকে পশু আসছে। করোনা পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে পশু কেনাবেচার যাবতীয় প্রস্তুতি ইতিমধ্যে সম্পন্ন করেছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। কয়েকটি হাট ঘুরে দেখা গেছে, ক্রেতারা আসছেন। পশু দেখছেন। ব্যবসায়ীরা দাম হাঁকাচ্ছেন। ক্রেতার চাহিদার আলোকে ব্যবসায়ীরা দাম কমাচ্ছেন এবং বাড়াচ্ছেন। ৫০-৭০ হাজার টাকা দামের গরু বিক্রি বেশি। সময়ের সঙ্গে দাম ওঠানামা করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। অনেকে বলছেন, এবার গরুর হাটের সংখ্যা কম হওয়ায় গরুও কম উঠবে। এ কারণে শেষ দিকে গরু সংকটে দাম বেড়ে যেতে পারে। মৌসুমি অনেক ব্যবসায়ী এবার গরু আনছেন না। গতকাল আফতাবনগর হাট ঘুরে দেখা গেছে, এ হাটে অন্তত তিন হাজার গরু উঠেছে। প্রতি বছরের মতো এবারও উৎসুক মানুষের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। অনেককে হাটে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছে। ২-৩ জন করে একত্রে গরু দেখছেন, দাম শুনছেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে মাইকিং করা হলেও ব্যবসায়ী, ইজারাদার প্রতিনিধি বা ক্রেতারা কমই তা মানছেন। জামালপুরের ব্যবসায়ী ইমরুল কায়েস জানান, হাটে তিনটি ষাঁড় এনেছেন। দেশীয় প্রজাতির প্রতিটি ষাঁড়ের দাম তিনি হেঁকেছেন ১ লাখ ২০ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা।

ক্রেতাদের একজন ইমান আলী বলেন, আমার বাসা বনশ্রী। এ হাট থেকে গরু কেনার চিন্তা করছি। এ জন্য হাটের পরিস্থিতি বোঝার জন্য এসেছি। মেরাদিয়া বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বিক্রি নেই, ক্রেতারা ঘোরাঘুরি করে দাম শুনে চলে যাচ্ছেন। ধূপখোলা গরুর হাটে ছোট গরুর বিক্রি বেশি। ছাগলও বিক্রি হচ্ছে বেশ। ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকার গরু বেশি বিক্রি হচ্ছে। মাঝারি এবং বড় সাইজের গরু দরদাম করে চলে যাচ্ছেন ক্রেতা। রাজধানীর সবচেয়ে বড় স্থায়ী পশুর হাট ঐতিহ্যবাহী গাবতলী গরুর হাট। কিন্তু এবার কোরবানি ঈদে পর্যাপ্ত গরু থাকলেও ক্রেতা নেই বলে জানান ব্যবসায়ীরা। ঈদের আর তিন দিন বাকি থাকলেও হাটে তেমন বেচাকেনা নেই। তবে অনেকেই হাটে আসছেন। দাম-দর করছেন, কিন্তু গরু কিনছেন না। যারাও আসছেন তাদের চাহিদা ছোট কিংবা মাঝারি সাইজের গরু। ফলে মাথায় হাত পড়েছে গরু ব্যবসায়ীদের। ন্যায্যমূল্যের চেয়ে কম দাম চেয়েও বিক্রি করতে পারছেন না গরু। শেষ মুহূর্তে কাক্সিক্ষত দামে বিক্রি করতে পারবেন কিনা তা নিয়েও সংশয়ে আছেন। শুধু বেপারী নয়, মাথায় হাত পড়েছে পিকআপ চালকদেরও। হাট থেকে তেমন গরু বিক্রি না হওয়ায় তারাও তেমন ট্রিপ দিতে পারছেন না। এদিকে, গাবতলী পশুর হাটে গরুপ্রতি ২-৩ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বেপারীরা। যদিও হাট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি অস্বীকার করে বলছে, কিছু জায়গার মালিক অন্যরা হওয়ায় তারা জোরপূর্বক বেপারিদের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে। অপরদিকে হাটের প্রতিটি গেটে পর্যাপ্ত সুরক্ষাব্যবস্থা থাকলেও নিয়ম মানছে না কেউ। কুষ্টিয়ার গরু ব্যবসায়ী রতন কুমার বলেন, গত রবিবার ১৫টি গরু নিয়ে হাটে এসেছেন। এখনো একটিও বিক্রি হয়নি। ন্যায্য দামের চেয়ে কম চেয়েও বিক্রি করতে পারছেন না।

কাছে যে টাকা ছিল তাও শেষ। গরু বিক্রি না হলে কীভাবে বাড়িতে ফিরবেন সে চিন্তায় পড়ে গেছেন। তিনি বলেন, শেষ সময়ে বিক্রি হলে আগে থেকেই ভাব বোঝা যায়। কিন্তু ক্রেতারা অর্ধেক দাম বলে চলে যাচ্ছে।

সিরাজগঞ্জ থেকে ২০টি গরু নিয়ে গাবতলী হাটে এসেছেন সালাম বেপারি। তিনি বলেন, গত রবিবার গরু নিয়ে হাটে আসছি। করোনার কারণে অনেক ব্যবসায়ী এবার হাটে কম গরু নিয়ে আসছেন। আমি গত তিন বছর ধরে হাটে গরু আনি। এবারও এনেছি। আমার তিনটি গরু নিজের গোয়ালের আর বাকি গরু আমি বাড়ি বাড়ি গিয়ে কিনে হাটে এনেছি। আমার ২০টি গরুতে খরচ পড়েছে ৩০ লাখ টাকা। আশা করি, এ বাজারে ৪০ লাখ টাকা বিক্রি করতে পারব।

নড়াইল থেকে আসা এসআরএস অ্যাগ্রোর কর্মচারী মো. আশিক বলেন, অনলাইনে তাদের মাঝারি সাইজের ১৬টি গরু বিক্রি হলেও বড় কোনো গরু বিক্রি করতে পারছেন না। তিনটি বড় গরুর সঙ্গে মাঝারি সাইজের একটি গরু ফ্রি দেওয়ার অফারেও মিলছে না ক্রেতা। হাটের বেশির ভাগ বিক্রেতাই জানালেন, টুকটাক যে গরু বিক্রি হচ্ছে সবই ছোট ও মাঝারি সাইজের। বড় গরুর ক্রেতা এবার নেই বললেই চলে।

প্রতি বছরের মতো এবারও গরু-ছাগলের কমতি নেই। কিন্তু ক্রেতার সংখ্যা খুবই কম। হাটে প্রবেশপথের গেটগুলোতে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা থাকলেও কেউ নিয়ম মানছেন না। এমনকি হাটে মানা হচ্ছে না নিরাপদ দূরুত্ব। অনেকে মাস্ক না পরেই হাটে ঘুরছেন। হাট কর্তৃপক্ষ বিনামূল্যে মাস্ক সরবরাহ করলেও সেখানেও সাড়া মিলছে না কারও।

কমলাপুর, খিলগাঁও, শাহজাহানপুর, ডেমরার আমুলিয়া মডেল টাউন, ডুমনি, মৈনারটেক এবং উত্তরা ১৭ নম্বর সেক্টর হাটেও অনেক গরু উঠেছে। এসব হাটেও ক্রেতারা আসছেন, ঘুরে ঘুরে দেখছেন, দাম জানছেন। কোনো কোনো হাটে স্বল্পপরিসরে বিক্রিও শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। দনিয়া হাটে শুক্র, শনি এবং রবিবার পশু বিক্রির কথা জানা গেছে।

পশু ব্যবসায়ী মো. সাফায়েত হোসেন বলেন, অন্যবারের চেয়ে এবার গাবতলী হাট, হাজারীবাগ হাটে গরু কম উঠেছে। এ কারণে চাহিদা বাড়লে শেষ দিকে গরুর সংকট এবং দাম বাড়তে পারে বলে। এখনো ট্রাকে ট্রাকে আসছে গরু। রবিবার সকাল থেকে বিক্রি বাড়লেও আজ থেকে পুরোদমে কেনাবেচা জমে উঠবে বলে আশা করছেন ইজারাদার ও ব্যবসায়ীরা।

জানা গেছে, ঈদের দিনসহ পাঁচ দিনের জন্য হাটের ইজারা দেওয়া হলেও কয়েক দিন আগে থেকেই হাটগুলোতে পশু আনা হচ্ছে। বিষয়টিকে স্বাভাবিক হিসেবেই দেখছেন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। এবার দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় ১১টি এবং উত্তর সিটি এলাকায় ছয়টিসহ মোট ১৭টি অস্থায়ী পশুর হাটে কোরবানির পশুর বেচাকেনার জন্য ইজারা দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ না করলে ইজারা বাতিলের শর্ত রয়েছে। কিন্তু কেউ সেটা মানছে না।

ডিএসসিসির ১১ পশুর হাটের মধ্যে রয়েছে- কমলাপুর লিটল ফ্রেন্ডস ক্লাবসংলগ্ন গোপীবাগ বালুর মাঠ ও কমলাপুর স্টেডিয়ামসংলগ্ন বিশ্বরোডের আশপাশের খালি জায়গা, আফতাবনগর ব্লক-ই, এফ, জি-এর সেকশন ১ ও ২ নম্বর এলাকা, হাজারীবাগ লেদার টেকনোলজি কলেজসংলগ্ন খালি জায়গা, উত্তর শাহজাহানপুরে খিলগাঁও রেলগেট বাজারের মৈত্রী সংঘের মাঠসংলগ্ন খালি জায়গা, পোস্তগোলা শ্মশানঘাটসংলগ্ন খালি জায়গা, মেরাদিয়া বাজারসংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা, দনিয়া কলেজ মাঠসংলগ্ন খালি জায়গা, ধূপখোলা মাঠসংলগ্ন খালি জায়গা, সাদেক হোসেন খোকা মাঠের পাশে ধোলাইখাল ট্রাক টার্মিনালসংলগ্ন উন্মুক্ত জায়গা, আমুলিয়া মডেল টাউনের খালি জায়গা এবং রহমতগঞ্জ খেলার মাঠসংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা। ডিএনসিসি এলাকায় ছয়টি হাটের মধ্যে একটি স্থায়ী এবং পাঁচটি অস্থায়ী হাট। স্থায়ী হাটটি গাবতলীতে। অস্থায়ী পাঁচটি হাট হচ্ছে- উত্তরা ১৭ নম্বর সেক্টরে বৃন্দাবন থেকে উত্তর দিকে বিজিএমইএ ভবন পর্যন্ত খালি জায়গা, কাওলা শিয়াল ডাঙ্গা সংলগ্ন খালি জায়গা, ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্বাচল ব্রিজ সংলগ্ন মস্তুল ডুমনী বাজারমুখী রাস্তার উভয় পাশের খালি জায়গা, ভাটারা (সাইদ নগর) পশুর হাট এবং উত্তরখান মৈনারটেক হাউজিং প্রকল্পের খালি জায়গা।

ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. রাসেল সাবরিন বলেন, পশুর হাটে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে ১১টি মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিটি কমিটিতে একজন করে ম্যাজিস্ট্রেট থাকছে। আমাদের নির্ধারিত গাইডলাইনের বাইরে কোনো অনিয়ম পরিলক্ষিত হলে সঙ্গে সঙ্গে তারা ব্যবস্থা নেবেন। এমনকি সংশ্লিষ্ট হাটের ইজারা বাতিল করা হবে। ডিএনসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. মোজাম্মেল হক বলেন, পশুর হাটে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে কিনা তা মনিটরিংয়ের জন্য ডিএনসিসির ১৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. মফিজুর রহমানকে আহ্বায়ক করে ১০ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিটি হাটে মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর