বৃহস্পতিবার, ৩০ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

পানিবন্দী লাখো মানুষের ঈদ

১৭ নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে

নিজস্ব প্রতিবেদক

পানিবন্দী লাখো মানুষের ঈদ

পদ্মার পানি বৃদ্ধির কারণে বসতবাড়িতে পানি প্রবেশ করায় চরম দুর্ভোগে মুন্সীগঞ্জের সংগ্রামপুর গ্রামের মানুষ -রোহেত রাজীব

দুই দিন বাদেই ঈদুল আজহা। অথচ, এখনো ১৮টি জেলার ২৫ লাখেরও বেশি মানুষ পানিবন্দী হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। নেই কাজ, জুটছে না তিনবেলা খাবার, সংকট বিশুদ্ধ পানি ও চিকিৎসার। ঈদে পরিবারের শিশু সন্তানটির জন্য নতুন পোশাক কিনতে না পেরে গোপনে চোখের পানি ফেলছেন অসহায় বাবা-মা। টানা মাসব্যাপী বন্যায় পথের ফকির হয়ে গেছেন অনেক মানুষ। কষ্টের ফসল ডুবে যাওয়ায় হাহাকার করছে দরিদ্র কৃষক। কিছু নদীর পানি কমতে শুরু করলেও এলাকা থেকে এখনো নামেনি বন্যার পানি। এর মধ্যেই আবার বাড়তে শুরু করেছে বেশ কয়েকটি প্রধান নদ-নদীর পানি। এখনো ১৭টি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আজকের মধ্যে তিস্তার পানি ডালিয়া পয়েন্টে নতুন করে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। ঢাকা সিটির নিম্নাঞ্চলে আজ বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, এক দিনের ব্যবধানে গতকাল সকালে ১০১টি পর্যবেক্ষণাধীন পানি সমতল স্টেশনের ৪৭টিতে পানি বেড়েছে। ১৭টি নদ-নদীর পানি ২৭টি স্টেশনে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনার পানি সমতল হ্রাস পেলেও স্থিতিশীল রয়েছে গঙ্গা-পদ্মার পানি। বৃদ্ধি পাচ্ছে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আপার মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদীগুলোর পানি সমতল। ঢাকা জেলার আশপাশের নদীগুলোর পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিস্তা ও ধরলার পানি ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টায় বৃদ্ধি পেতে পারে এবং তিস্তা নদী ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। আজ ঢাকা সিটি করপোরেশনের নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। তবে আজ কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, নওগাঁ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। অপরিবর্তিত থাকতে পারে মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, চাঁদপুর, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্যা পরিস্থিতি। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো আরও তথ্য- শরীয়তপুর : পদ্মার পানির তীব্র স্রোত ও ভাঙনে ভেসে গেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাড়িঘর। শরীয়তপুরে নড়িয়া উপজেলার চরআত্রা ইউনিয়নে পদ্মার আকস্মিক ভাঙনে গতকাল দুপুরে বসাকের চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। পাশে থাকা আরও একটি  শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যে কোনো সময় নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে। বন্যা আর ভাঙনে দিশাহারা হয়ে পড়েছে অসংখ্য পরিবার। এদিকে পদ্মা ও কীর্তিনাশা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় শরীয়তপুর জেলার বন্যার পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। নতুন-নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।  শরীয়তপুর জেলার শরীয়তপুর  সদর, নড়িয়া, জাজিরা,  ভেদরগঞ্জ, ডামুড্ডা উপজেলার অন্তত ৪২টি ইউনিয়ন বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। তিন লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছে। সিরাজগঞ্জ : একদিকে করোনায় কর্মহীন, অন্যদিকে বন্যার পানি ও ভাঙনে দুর্বিষহ জীবন পার করছেন এ জেলার বন্যা কবলিতরা। তাদের অভিযোগ, কষ্টে থাকলেও খোঁজ নিচ্ছেন না জনপ্রতিনিধিরা। এমনকি সরকারি সহায়তাও তারা ঠিকভাবে পাচ্ছেন না। সরকারের পক্ষ থেকে মাত্র দশ কেজি চাল দেওয়া হয়েছে, যা একটি পরিবারের মাত্র তিন দিনের খাবার। সে চালও অধিকাংশ বন্যা কবলিতদের ঘরে পৌঁছেনি। পানির মধ্যে থেকে অসুখ হলেও চিকিৎসা মিলছে না। সারারাত সাপ, বিচ্ছুর ভয় নিয়েই পানিবন্দী দিন পার হচ্ছে। তারা বলেন, দুই দিন পরে ঈদ। কিন্তু আমাদের ঘরে ঈদ নেই। শিশু সন্তান নতুন পোশাকের বায়না ধরলেও তা কিনে দেওয়ার সামর্থ্য নেই। তিনবেলা খাবারই জুটছে না। সেমাই-চিনির জোগাড় হবে কীভাবে?’ চরমিপুর এলাকার রুমি খাতুন ও নাজমা বেগম কাজ করতেন সুতার মিলে। তারা বলেন, ‘করোনা আর বন্যায় চার মাস কাজ নেই। দুই দিন বাদে ঈদ। ছেলেমেয়েকে কোনো কিছু কিনে দিতে পারিনি। এমনকি সন্তানের মুখে একটু সেমাই দিতে পারব কিনা তাও জানা নেই। আর পানির মধ্যে ঈদ বা করব কীভাবে?’ বগুড়া : সোনাতলায় বন্যার পানির স্রোতে একটি ব্রিজ ভেঙে যাওয়ায় উপজেলা সদরের সঙ্গে ২৫ গ্রামের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। গত সোমবার দিবাগত গভীর রাতে বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার তেকানীচুকাইনগর ইউনিয়নের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ সংলগ্ন ব্রিজটি ভেঙে যায়। এতে করে উপজেলা সদরের সঙ্গে ৩টি ইউনিয়নের ২৫ গ্রামের প্রায় ৭৫ হাজার মানুষের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এ ছাড়া চলতি বছরের অবিরাম বর্ষণ ও বন্যার কারণে বগুড়ার সোনাতলা পৌরসভার রাস্তাঘাটের বেহালদশা হয়েছে।

 মোকামতলা-সোনাতলা বন্দর, সোনাতলা বন্দর-জুমারবাড়ী সড়ক, বাসস্ট্যান্ড-স্টেডিয়াম সড়ক, উপজেলা গেইট-হাসপাতাল সড়ক, সোনাতলা-কামারপাড়া সড়ক, ঘোড়াপীর-গড়ফতেপুর সড়ক, সোনাতলা ফায়ার সার্ভিস-আগুনিয়াতাইড় সড়ক, সোনাতলা বাসস্ট্যান্ড-মাস্টারপাড়া সড়ক, সোনাতলা হাসপাতাল-মাগুরাদহ ব্রিজ সড়ক অতি বর্ষণ ও বন্যার কারণে খানাখন্দকে পরিণত হয়েছে। মাদারীপুর : শিবচরের আড়িয়াল খাঁ তীরবর্তী সন্ন্যাসীরচর, শিরুয়াইল, নিলখী ও বহেরাতলা দক্ষিণেও নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। প্লাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চল। এ ছাড়াও সদর উপজেলার শিরখাড়া, পাঁচখোলা, কালিকাপুর এবং কালকিনি উপজেলার লক্ষ্মীপুরসহ বেশ কয়েকটি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এ পর্যন্ত নদীতে বিলীন হয়েছে সাড়ে ৪ শতাধিক ঘরবাড়ি। কিছু কিছু এলাকায় জিও ব্যাগ ডাম্পিং করেও কাজ হচ্ছে না। মাদারীপুর জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন বলেন, মাদারীপুরে বন্যাকবলিত এলাকায় ২১টি আশ্রয় কেন্দ্রে খোলা হয়েছে। সেসব আশ্রয় কেন্দ্র প্রায় তিন হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। মুন্সীগঞ্জ : পদ্মা, মেঘনা ও ধলেশ্বরী নদীতে গত মঙ্গলবার রাত থেকে আবারো পানি বাড়তে শুরু করেছে। বন্যার পানিতে ভাসছে লৌহজং শ্রীনগর, টঙ্গিবাড়ী, সিরাজদীখান উপজেলার ২১টি ইউনিয়নের অসংখ্য গ্রাম। পানিতে তলিয়ে গেছে অসংখ্য মাছের ঘের ও হাটবাজারের  দোকানপাট। এতে করে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে জেলার প্রায় ৫০ হাজার পরিবার। বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সংকট  দেখা দিয়েছে। সেই সঙ্গে বসতবাড়িতে পানি উঠে পড়ায়  বেড়েছে সাপ ও কীট পতঙ্গের উৎপাত।

 

সর্বশেষ খবর