বৃহস্পতিবার, ৩০ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

মাদকের ভয়াবহ রুট চট্টগ্রাম

গোয়েন্দাদেরও ধাঁধায় ফেলছে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা

মুহাম্মদ সেলিম, চট্টগ্রাম

মাদকের ভয়াবহ রুট চট্টগ্রাম

ইয়াবা পাচারে গোয়েন্দাদেরও ধাঁধায় ফেলছে ইয়াবা কারবারিরা। প্রতিনিয়ত পরিবর্তন করছে পাচারের কৌশল। র‌্যাব-পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সদস্যদের ফাঁকি দিতে মাদক ব্যবসায়ীরা ব্যবহার করছে কাটআউট, রিলে, চালানদ্বার, ফ্রিজিং ক্যারিং ও স্টমাক ক্যারিং পদ্ধতি। কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে মাদক কারবারিরা বিভ্রান্ত করছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের। নামকাওয়াস্তে অল্প চালানসহ কিছু বহনকারী ধরা পড়লেও পাচারের বড় অংশ এবং হোতারা রয়ে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ফলে বানের পানির মতো দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে ইয়াবা। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মো. মজিবুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, ইয়াবা পাচারে ‘ফ্রিজিং ক্যারিং’ ও ‘স্টমাক ক্যারিং’ কিছুটা বেড়েছে বলে ধারণা করছি। এ দুই পদ্ধতিতে ইয়াবা পাচার করতে গিয়ে গত এক মাসে চট্টগ্রাম বিভাগে প্রায় ৪০টি চালান ধরা পড়েছে। যাদের আটক করা হয়েছে তাদের মধ্যে বেশির ভাগই হচ্ছে রোহিঙ্গা কিংবা কক্সবাজার অঞ্চলের লোকজন।

তিনি আরও বলেন, মাদক ব্যবসায়ীরা পরিবহনে নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করছে প্রতিনিয়ত। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরও তাদের নতুন নতুন কৌশলের কথা মাথায় রেখে অভিযান পরিচালনা করছে। এতে সফলতাও পাওয়া যাচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, ইয়াবার চালান বিশেষ কৌশলে বাহকের শরীরে প্রবেশ করানো হয়। পেটে করে পাচার করার পদ্ধতিকে বলা হয় স্টমাক ক্যারিং। স্পর্শকাতর অঙ্গে প্রবেশ করিয়ে পাচার পদ্ধতিকে বলা হয় ফ্রিজিং ক্যারিং পদ্ধতি। নতুন এ পদ্ধতিতে ১ হাজার থেকে ৮ হাজার পিস পর্যন্ত ইয়াবা পাচার করতে পারে একজন বহনকারী। পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে একেকটি চালানে ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত পেয়ে থাকেন বাহকরা। ফ্রিজিং ক্যারিং ও স্টমাক ক্যারিং পদ্ধতি অনুসরণ করলে আটক হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে কম থাকে। মহাসড়কে মাদক স্ক্যানার মেশিন না থাকায় প্রশাসনও সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া তল্লাশি করে না। এ ছাড়া এ দুই পদ্ধতি অনুসরণ করে কিছুটা আইনগত সুবিধা পাচ্ছে মাদকের বাহকরা। কারণ পেটে থাকা মাদক বের করতে হলেও চিকিৎসকের প্রয়োজন। বেশির ভাগ মামলায় দেখা যায় চিকিৎসকরা সাক্ষী হতে রাজি থাকেন না। এটাকেও বিশেষ সুবিধা মনে করছে মাদক ব্যবসায়ীরা। ‘ফ্রিজিং ক্যারিং’ এবং ‘স্টমাক ক্যারিং’ নাম দিলেও মাদক সাম্রাজ্যে এ দুই পদ্ধতিকে সাংকেতিক কোড হিসেবে ‘ফিশিং’ ডাকা হয়। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের অধিবাসীদের লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ইয়াবার চালান পৌঁছে দিতে রাজি করা হয়। জানা যায়, কক্সবাজার থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ইয়াবা পাচারের জন্য মাদক মাফিয়ারা ব্যবহার করছে জঙ্গি সংগঠনগুলোর মতো বহুল ব্যবহৃত ‘কাটআউট পদ্ধতি’। এ পদ্ধতিতে বাহক নিজেও জানে না ইয়াবার মূল ক্রেতা ও বিক্রেতার নাম। মাদকের চালানের সঙ্গে বাহককে দেওয়া হয় বিশেষ একটি সংকেত ও পোশাকের কিংবা একটি সুনির্দিষ্ট ব্যাগের রং। গন্তব্যে পৌঁছেই বাহক সংকেত দেওয়া ব্যক্তির হাতে পৌঁছে দেয় মাদকের চালান। কাটআউট পদ্ধতির মতোই আরেকটি পদ্ধতি হচ্ছে চালানদ্বার বা চলনদ্বার পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে বাহক নিজেই জানে না কার কাছে পৌঁছে দিতে হবে ইয়াবার চালান। বাহক শুধু জানে নির্ধারিত একটি স্থানে নিয়ে যেতে হবে ইয়াবার চালান। ওই জায়গায় পৌঁছার পর চালান গ্রহণকারী নিজেই ফোন করে ইয়াবা গ্রহণ করে। এ ক্ষেত্রে বাহকের সঙ্গে একজন অনুসরণকারী থাকে। চালান নির্ধারিত স্থানে পৌঁছে গেলে অনুসরণকারী বার্তা দেয় ইয়াবাগ্রহীতাকে। সম্প্রতি মাদক পাচারে ব্যবসায়ীদের বেশ আস্থার নাম ‘রিলে পদ্ধতি’। ম্যারাথন দৌড় পদ্ধতিকে অনুকরণ করে কক্সবাজার থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় চালান পৌঁছে দেওয়ার আগেই তিন থেকে চারবার বাহক পরিবর্তন করা হয়। এ ছাড়া মাদক পাচারে ব্যবহার করা হচ্ছে চলনদ্বার এবং চালানদ্বার পদ্ধতি। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর বিভাগীয় গোয়েন্দা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক হুমায়ুন কবির খন্দকার বলেন, ‘ইয়াবা পাচারে রোহিঙ্গাদের বাহক হিসেবে ব্যবহারের হার বেড়েছে আগের তুলনায়। যোগাযোগের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে অন্যজনের নামের রেজিস্ট্রেশন করা সিম। ফলে বাহক গ্রেফতার হলেও অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে হোতাদের হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। গোয়েন্দাদের চোখ এড়াতে সম্প্রতি ইয়াবা পরিবহনে ব্যবহার করা হচ্ছে ব্যক্তিগত ও পণ্যবাহী গাড়ি। অনেক ক্ষেত্রে প্রাইভেট গাড়ির সঙ্গে রাখা হচ্ছে নারীদেরও। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার চোখ ফাঁকি দিতেই কক্সবাজার থেকে ইয়াবা পরিবহনে ব্যবহার করা হচ্ছে এ কৌশল। গত এক মাসে চট্টগ্রামে অভিন্ন কায়দায় ইয়াবা পাচার করার সময় জব্দ করা হয় কমপক্ষে অর্ধশত চালান। চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার এস এম রশিদুল হক বলেন, প্রাইভেট কারে সাধারণত সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকজন চড়ে। সঙ্গে নারী থাকলেও এটাকে সন্দেহের চোখে দেখা হয় না। এ সুবিধা কাজে লাগাতে মাদক পরিবহনে হয়তো প্রাইভেট গাড়ি ও নারীদের ব্যবহার করছে। পুলিশ সুপার বলেন, এরই মধ্যে এ ধরনের বেশ কয়েকটি চালান আটক করা হয়েছে। তাই বিষয়টি মাথায় রেখে কাজ করতে প্রত্যেক থানাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

সর্বশেষ খবর