বৃহস্পতিবার, ৩০ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

জমছে কোরবানির পশুর হাট

হাটে হাটে মেডিকেল ও মনিটরিং টিম

শফিকুল ইসলাম সোহাগ ও আলী আজম

জমছে কোরবানির পশুর হাট

পবিত্র ঈদুল আজহার বাকি মাত্র দুই দিন। এরই মধ্যে জমে উঠছে রাজধানীর ১৭টি কোরবানির পশুর হাট। ছোট থেকে শুরু করে মাঝারি ও বিশালাকৃতির গরু উঠেছে হাটে। সেই সঙ্গে রয়েছে উট, দুম্বা, ছাগল। কোনো কোনো হাটে বৃহদাকৃতির গরুর দাম চাওয়া হচ্ছে ১০ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা। সব হাটে প্রচুর গরু উঠেছে। দিনে ক্রেতা কম থাকলে রাতে বাড়ছে। বিক্রেতারা দাম হাঁকাচ্ছেন। ক্রেতারা দরকষাকষি করছেন। ছোট ও মাঝারি আকারের পশু বিক্রি বেশি হয়েছে। ছাগলেরও বিক্রি বেড়েছে। অনেকে একটা গরুর সঙ্গে একটা ছাগল কিনছেন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বড় গরুর চাহিদা কম, ন্যায্য দাম বলছেন না ক্রেতারা। গতকাল বিক্রির পরিমাণ ছিল সামান্যই। যেহেতু সময় ঘনিয়ে এসেছে তাই আজ বৃহস্পতিবার থেকে ভালো দামে বিক্রি বেশি হতে পারে বলে আশা করছেন তারা। শেষ দিকে ভালো ব্যবসার আশায় দিন গুনছেন গরু ব্যবসায়ীরা। তবে হতাশা প্রকাশ করেছেন অনেক ব্যবসায়ী। তারা বলছেন, পশুর হাটেও মহামারী করোনার প্রভাব পড়েছে। পাশাপাশি যোগ হয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এ যেন পশুর হাটে মহামন্দা। রাজধানীর আফতাবনগর, কমলাপুর, লালবাগ, মোহাম্মদপুর ও গাবতলীর পশুর হাট ঘুরে এমনটাই দেখা গেছে।

পুরান ঢাকার লালবাগ বেড়িবাঁধ হাটে সিরাজগঞ্জের মোতাহার উদ্দিন জানান, তিনি নয়টি গরু এনেছেন। এখনো একটিও বিক্রি করতে না পারলেও আজকালের মধ্যে তার সব গরু বিক্রি হয়ে যাবে বলে তিনি আশাবাদী। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গরু নিয়ে আসা ব্যাপারীরা বলছেন, ঈদের আর মাত্র দুই দিন বাকি। এখনো যদি ক্রেতাদের মধ্যে কোরবানির পশু কেনার প্রবণতা না থাকে, তাহলে হয়তো কাক্সিক্ষত সংখ্যক গরু বিক্রি করতে পারবেন না।

যাত্রাবাড়ী থেকে কমলাপুর হাটে আসা আজগার আলী নামে এক ক্রেতা জানান, হাটে অনেক গরু এসেছে। গত বছর যে গরু ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে, এবার বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ হাজার টাকায়। আরেক ক্রেতা বায়েজিদ আলম বলেন, ‘ঈদের এক দিন আগে গরু কিনব। একটু সময় নিয়ে কোরবানির পশু দেখেশুনে কিনতে চাই। আপাতত দামদর যাচাই করছি। ব্যাপারীরা দাম ছাড়তে চাইছেন না। তবে পছন্দ হলে গরু কিনে ফেলব।’

এবার গাবতলীর হাটে বড় গরুর সংখ্যা বেশি। হাটটিতে গরু-ছাগলের পাশাপাশি উট ও দুম্বা তোলা হয়েছে। দুবাই থেকে আনা দুম্বাগুলোর দাম চাওয়া হচ্ছে ১ লাখ থেকে আড়াই লাখ পর্যন্ত। তবে একজন বিক্রেতা জানালেন, ৭০ হাজার টাকায় একটি দুম্বা বিক্রি হয়েছে। বড় বড় গরু দেখতে মানুষ স্বাস্থ্যবিধি ভেঙে ভিড় করছে। হাটের প্রতিটি গেটে পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকলেও নিয়ম মানছে না তারা। ফলে মহামারী করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা করছেন অনেকে।

শাহজাহানপুর হাটে গিয়ে দেখা গেছে, সাদা একটি গরুর পাশে ভিড়। ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে ঝিনাইদহ থেকে নিয়ে আসা গরুটির নাম রাখা হয়েছে ‘সাদাপাহাড়’। ব্যাপারী আজিজ মিয়া জানালেন, তিনি দাম হাঁকছেন ১০ লাখ টাকা। গরুটি কিনলে ক্রেতা পাবেন অন্য একটি ছোট গরু ফ্রি। আজিজের দাবি, সাদাপাহাড়ের দাম উঠেছে ৬ লাখ টাকা। কমলাপুর ও শনির আখড়া হাটে গিয়ে দেখা গেছে প্রচুর গরু। কিন্তু ক্রেতা কম। বৃষ্টির পানিতে হাটের মাখামাখি অবস্থা।

হাজারীবাগ হাটে গার্মেন্ট ব্যবসায়ী মুজাফফর হোসেন বলেন, ‘গরুর দাম বেশি চাইছেন ব্যাপারীরা। অযাচিত দাম চাইলে কিনব কেমন করে?’ দাম নিয়ে ক্রেতাদের এমন ‘আপত্তি’র সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করছেন কুষ্টিয়ার মিরপুর থেকে আসা ব্যাপারী জহির উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আমি ১২টা গরু আনছি। এখনো একটাও বিক্রি হয়নি। দু-একজন দাম জিজ্ঞাসা করছেন। কাস্টমার তেমন নেই। সামান্য লাভ পেলেই বিক্রি করে দেব। লাখ টাকার গরুর দাম দিতে চায় ৬০ হাজার।’ ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথের দুই পাশে কমরূপুরে পশুর হাট বসানো হয়েছে। এ ছাড়া এলাকার বিভিন্ন অলিগলি ও সড়কপথে পশুর হাট বসেছে। বাসাবাড়ির সামনের সড়কে গরু রাখা হয়েছে। এতে যেমন চলাচলের দুর্ভোগ, তেমন করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা কমলাপুর, মেরাদিয়া বাজার ও দনিয়া কলেজ মাঠ-সংলগ্ন এলাকায়। এসব এলাকার অস্থায়ী পশুর হাটের কোনো সীমানা নেই।

কুষ্টিয়া থেকে ১০টি গরু নিয়ে রাজধানীর কমলাপুর এসেছেন কেরামত আলী। তিনি বলেন, ‘আজ দুপুরে এসে নেমেছি। একজন ক্রেতা এসে একটি গরুর দর করেছেন। ৭০ হাজার পর্যন্ত বলেছেন। আমি ১ লাখ টাকার কথা বলেছি। গত বছর এ হাটে প্রথমে ১০টি, পরে আরও পাঁচটি গরু এনে বিক্রি করেছিলাম। তাতে মোটামুটি ভালো একটা লাভ পেয়েছিলাম। এবারও কিছু লাভের আশায় অনেক কষ্ট করে এখানে এসেছি। জানি না ভাগ্যে কী লেখা আছে!’

ঝিনাইদহের খামারি হাকিম মিয়া জানান, গতকালই তিনি গরু নিয়ে কমলাপুরের হাটে এসেছেন। এখন পর্যন্ত কোনো গরু বিক্রি করতে পারেননি। হাকিম মিয়ার মতো অনেকেই রাজধানীর বিভিন্ন হাটে কোরবানির পশু নিয়ে এসেছেন। তবে ক্রেতার সংকটে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা। বাবু সরকার নামে একজন বিক্রেতা জানান, তিনি যে দামে বিক্রির আশায় হাটে গরু এনেছেন, সে দামের ধারেকাছে কেউ বলেনইনি। বাজেট কম বলে জানাচ্ছেন ক্রেতারা।

গোপীবাগ রেললাইনের পাশে ১৫টি গরু নিয়ে অবস্থান করছেন ফরিদপুরের ব্যাপারী ফারুক মিয়া। তিনি বলেন, ‘ভাই, আমরা জানতাম হাট শুরু হবে ঈদের পাঁচ দিন আগে। তাই সাত দিন হাতে নিয়ে রবিবার কমলাপুর হাটে আসি। কিন্তু হাটের ভিতরে কোনো জায়গা নেই। তাই হাট ব্যবস্থাপনার লোকেরা রেললাইনের পাশে জায়গা দিয়েছেন। ১৫টি গরুর জন্য ১৫ হাজার টাকা ভাড়া নিয়েছেন। আমরা তো ইচ্ছা করে এখানে বসি না।’ কয়েকজন ক্রেতা বলছেন, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় গরু লালনপালনে সমস্যার কারণে ঈদের এক দিন আগে তারা গরু কিনবেন। এখন তারা বিভিন্ন হাটে গিয়ে দর যাচাই করছেন। সময় এলে কাক্সিক্ষত হাট থেকে গরু কিনবেন। বৃষ্টির পানিতে গরু ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এজন্য আগেভাগে গরু কিনতে চাইছেন না তারা। তবে অনেক ক্রেতা এসব উপেক্ষা করে বাজেট অনুযায়ী পছন্দের গরু কিনছেন। কয়েকটি হাট ঘুরে দেখা গেছে, আশানুরূপ ক্রেতা নেই। যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন না ব্যবসায়ীরা। অনেকের মুখে মাস্ক নেই। সামাজিক দূরত্ব মানছেন না। বড়দের সঙ্গে শিশুরাও হাটে আসছে। সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে সড়ক, রেলপথ ও বাসাবাড়ির সামনে গরুর হাট বসেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা সংক্রমণে পশুর হাট খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তাই এবার রাজধানীতে পশুর হাট ইজারা না দিতে সুপারিশ করেছিল জাতীয় কারিগরি কমিটি। একই বিষয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছিল স্বাস্থ্য বিভাগ। কিন্তু ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন কোনো নির্দেশনা মানেনি। সারা দেশ থেকে ব্যাপারীরা ট্রাকে পশু নিয়ে হাটে এসে যত্রতত্র বসছেন। এভাবে হাটে অবাধে বেচাকেনা ও ঘুরে বেড়ানোর কারণে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে পারে। সিটি করপোরেশনের নির্দেশনা অনুযায়ী, ২৮ জুলাই থেকে চাঁদরাত পর্যন্ত অস্থায়ী পশুর হাট কার্যকর থাকবে। কিন্তু ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে ১৭টি পশুর হাট ২০ জুলাই বসানো শুরু হয়েছে। দেশের উত্তরাঞ্চলসহ বিভিন্ন স্থানে বন্যার কারণে অনেক ব্যাপারী আগেভাগেই পশু নিয়ে ঢাকায় চলে এসেছেন। তাই ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর অনেক ব্যাপারী দেরিতে আসায় মূল হাটে জায়গা না পেয়ে আশপাশে সড়কে অবস্থান নিয়েছেন।

পশুর হাটে মেডিকেল-মনিটরিং টিম : ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন কোরবানির পশুর হাটে ভেটেরিনারি মেডিকেল টিমের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। মেডিকেল টিমসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি তদারকির জন্য গতকাল কার্যক্রম শুরু করেছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় গঠিত মনিটরিং টিম। এ কার্যক্রমের জন্য ইতোমধ্যে আটটি মনিটরিং টিম গঠন করেছে মন্ত্রণালয়। প্রতিটি টিমে মন্ত্রণালয়ের একজন করে উপসচিবকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এদিকে কোরবানির পশুর হাটে ভেটেরিনারি মেডিকেল সেবা কার্যক্রম পরিচালনায় ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন হাটগুলোয় গতকাল সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করেছে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের গঠিত ১৮টি ভেটেরিনারি ও একটি বিশেষজ্ঞ ভেটেরিনারি মেডিকেল টিম। আগামীকাল শুক্রবার পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ভেটেরিনারি মেডিকেল সেবা দেবে এ টিম। এ ছাড়া প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের উদ্যোগে সারা দেশে কোরবানির পশুর হাটেও কাজ শুরু করছে ভেটেরিনারি মেডিকেল টিম। কোরবানির পশুর হাটে রোগাক্রান্ত ও কোরবানির অনুপযোগী গবাদি পশু বিক্রি বন্ধসহ সুস্থসবল পশু বিক্রি নিশ্চিত এবং গবাদি পশুর তৎক্ষণাৎ চিকিৎসাসেবা দিতে ভেটেরিনারি মেডিকেল টিমগুলো কাজ করবে। গতকাল মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

কন্ট্রোল রুম : কোরবানির পশুর হাট, কোরবানির স্থান ও বর্জ্য অপসারণ-সংক্রান্ত তথ্যের জন্য ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন-ডিএনসিসির গুলশানের নগর ভবনে কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়েছে। আজ সকাল ৯টা থেকে সোমবার পর্যন্ত কন্ট্রোল রুম খোলা থাকবে। কন্ট্রোল রুমের নম্বর- ০২-৫৮৮১৪২২০, ০৯৬০-২২২২৩৩৩, ০৯৬০-২২২২৩৩৪। নগরবাসী কন্ট্রোল রুমে ফোন করে পশু কোরবানির নির্ধারিত স্থান জেনে নিতে পারবেন। পশু কোরবানির জন্য এ বছর ডিএনসিসিতে মোট ২৫৬টি স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া কোরবানি দেওয়ার পরে কোথাও পশুর বর্জ্য অপসারণ করা না হলে তা কন্ট্রোল রুমকে জানালে তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কোরবানির পশুর হাট, ডিজিটাল হাট, অনলাইনে কোরবানি দিয়ে মাংস প্রস্তুত করে বাসায় পৌঁছে দেওয়া-সংক্রান্ত তথ্যও কন্ট্রোল রুম থেকে জানা যাবে। গতকাল ডিএনসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা এ এস এম মামুন এসব তথ্য নিশ্চিত করেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর