বৃহস্পতিবার, ৩০ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

পুরুষের চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত নারীরা

করোনায় কাজ নেই

জিন্নাতুন নূর

করোনা মহামারীর তা-বে শিল্প-বাণিজ্য ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতসহ বিভিন্ন খাত অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন স্থানে শুরু হয়েছে গণছাঁটাই। কেউ কেউ কর্মীদের বেতন কমিয়ে দিচ্ছেন। আর এই প্রক্রিয়ায় পুুরুষের চেয়েও নারী কর্মজীবীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, করোনায় নারীপ্রধান পরিবারের আয় কমেছে ৮০ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনা সংক্রমণের ফলে নারীরা চাকরি হারাচ্ছেন। এ ছাড়া নারী উদ্যোক্তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে তাদের জীবনযাত্রার মান নেমে যাচ্ছে, তারা সহিংসতার শিকার হচ্ছেন।

করোনায় নারীদের চাকরি হারানোর ঝুঁকি অনেক বেড়েছে বলে এরই মধ্যে সতর্ক করে দিয়েছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)। মে মাসে পরিচালিত বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের এক গবেষণায় বলা হয়, করোনায় নারীপ্রধান পরিবারের আয় কমেছে ৮০ শতাংশ। আর এই সময়ে নারীপ্রধান পরিবারের ৫৭ শতাংশের কোনো উপার্জন নেই। এ ছাড়া বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন স্টেপস টুওয়ার্ডস ডেভেলপমেন্ট (স্টেপস) এবং জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যালায়েন্সের (গ্যাড অ্যালায়েন্স) তথ্য অনুযায়ী, লকডাউনের সময় থেকে ৮০ শতাংশ গ্রামীণ ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা তাদের চলমান ব্যবসা বা উদ্যোগ বন্ধ রাখতে বাধ্য হন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে সব শ্রেণি-পেশার নারীই কাজ হারাচ্ছেন কিংবা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এর মধ্যে ছাঁটাইয়ের শিকার হচ্ছেন পোশাক খাতের নারী কর্মীরা। বেসরকারি খাতে কর্মরত নারী কর্মকর্তারাও চাকরি হারাচ্ছেন। কারও বেতন কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। নারী ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা পুঁজি হারাচ্ছেন। সুরক্ষার কথা চিন্তা করে অনেক নারী গৃহকর্মীকেই কাজে যেতে বারণ করা হচ্ছে। এ অবস্থায় অনেক নারী গৃহকর্মী ভিক্ষাবৃত্তির পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। শিক্ষিত কর্মজীবী নারীরা ঘরে বসে খাবার বানিয়ে অনলাইনে বিক্রি করছেন। নারী পোশাকশ্রমিকদের কেউ কেউ বিক্রি করছেন পান-সিগারেট। বিশেষ করে যেসব নারী সংসারে একমাত্র উপার্জনকারী, তারা গোটা পরিবার নিয়ে বিপাকে পড়ছেন। মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা বলেন, করোনা মহামারীর কারণে বিশ্বব্যাপী নারীরা আর্থিক, সামাজিক ও স্বাস্থ্যগতভাবে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। নারীরা চাকরি হারাচ্ছেন। এ ছাড়া উদ্যোক্তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে তাদের জীবনযাত্রার মান নেমে গেছে ও সহিংসতার স্বীকার হচ্ছেন। এ সংকটকালে তিনি জাতিসংঘের এজেন্সিসমূহ, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ও উন্নয়ন অংশীদারদের করোনা সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত নারী কর্মজীবী, নারী উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের সহায়তায় এগিয়ে আসার অনুরোধ জানিয়েছেন। মিরপুরের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন সুফিয়া খাতুন। করোনা সংক্রমণের পর বাড়ি গিয়ে লকডাউনে আটকা পড়েন সুফিয়া। কিন্তু কাজে ফিরে এসে দেখেন, তিনিসহ তার আরও অনেক সহকর্মীকে কারখানা থেকে ছাঁটাই করা হয়েছে। ঢাকার দুয়ারীপাড়া বস্তিতে ভাড়া থাকতেন এই পোশাককর্মী। গ্রামে বৃদ্ধ মায়ের কাছে সুফিয়া তার পাঁচ বছরের সন্তানকে রেখে এসেছেন। সন্তানের লেখাপড়া ও মায়ের হাতখরচের টাকা পাঠাতে হতো এই নারীকে। কিন্তু কাজ হারানোর এক মাসে নতুন কাজ খুঁজে না পেয়ে বিপাকে পড়ে এখন পথে পথে চা-সিাগরেট বিক্রি করছেন সুফিয়া। শাপলা আক্তার রাজধানীর কালশীতে বাসাবাড়ির কাজ করতেন। করোনা সংক্রমণের পর শাপলার গৃহকর্ত্রীরা শাপলাকে কাজে আসতে বারণ করেন। দুর্ঘটনায় শাপলার স্বামী এক পা হারিয়েছেন। এ জন্য দুই ছেলেমেয়েসহ সংসারের সব খরচ শাপলাকেই বহন করতে হয়। কিন্তু কাজ না থাকায় এখন ভিক্ষা করতে হচ্ছে শাপলাকে। ছোট মেয়েকে নিয়ে প্রতিদিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত মানুষের কাছে হাত পেতে যা পান তা দিয়েই চলছে শাপলার সংসার। রাজধানীর ধানমন্ডির একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) সম্প্রতি বিনা নোটিসেই চাকরি হারিয়েছেন। চাকরি থেকে ছাঁটাইয়ের এক দিন আগে সেই শিক্ষিকাকে শুধু একটি খুদেবার্তা (এসএমএস) পাঠানো হয়। তিনি বলেন, ‘আমাদের পাওনা না দিয়েই হঠাৎ করে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। আমার স্বামীর ব্যবসাও করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত। এ অবস্থায় আসছে দিনে সংসার খরচ ও বাসা ভাড়ার টাকা কীভাবে আসবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।’ অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনা সংক্রমণে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও কাজ হারাচ্ছেন। তারা যেসব ক্ষেত্রগুলোতে কাজ করতেন, বিশেষ করে পোশাক খাত, বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যাংক থেকে তাদের ছাঁটাই করার খবর পাচ্ছি। আর এ ক্ষেত্রে আমাদের কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের যে লিঙ্গসমতা অর্জিত হয়েছে, সেখানে পিছিয়ে পড়ারও আশঙ্কা রয়েছে।’

সর্বশেষ খবর