বুধবার, ৫ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

রপ্তানির ঘোষণাও ঠেকাতে পারেনি চামড়ার মূল্য বিপর্যয়

সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া কেনার ঘোষণা ট্যানারি মালিকদের

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

গতবারের চামড়ার দামে বিপর্যয় ঠেকাতে এবার ঈদের আগেভাগেই কাঁচা চামড়া ও ওয়েট ব্লু রপ্তানির ঘোষণা দিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে বাস্তবতা হচ্ছে : এই ঘোষণার কোনো প্রতিফলন পড়েনি চামড়ার দামে। বরং দাম না পেয়ে এবারও কাঁচা চামড়া পদ্মা নদীতে ফেলে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। সিলেট থেকে ঢাকায় বিক্রি করতে নিয়ে এলেও প্রায় হাজার খানেক চামড়ার দাম না পেয়ে ফেলে গেছেন ব্যবসায়ীরা। মাঝারি মানের গরুর চামড়ার দাম ৭০০ থেকে ১০০০ টাকা হওয়ার কথা থাকলেও রাজধানীতে গরুর চামড়া আকারভেদে ২০০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ছাগলের চামড়া বিক্রি হয়েছে ২ থেকে ১০ টাকায়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ঈদের আগে চামড়া শিল্পের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে। ঢাকায় লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ৩৫ থেকে ৪০ টাকা ধরা হয়। আর ঢাকার বাইরে ধরা হয়েছে প্রতি বর্গফুট ২৮ থেকে ৩২ টাকা। এ ছাড়া সারা দেশে খাসির চামড়া  গত বছরের প্রতি বর্গফুট ১৮ থেকে ২০ টাকা থেকে কমিয়ে ১৩ থেকে ১৫ টাকা করা হয়। আর গতবারের মূল্য বিপর্যয় ঠেকাতে গত ঈদের আগেই তড়িঘড়ির করে কাঁচা চামড়া ও ওয়েট ব্লু রপ্তানির অনুমতি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। সূত্র জানায়, এ ধরনের পরিস্থিতিতে গতকাল কাঁচা চামড়ার পরিস্থিতি নিয়ে জরুরি বৈঠক করেন বাণিজ্য সচিব ড. মো. জাফর উদ্দিন। ওই বৈঠকে ট্যানারি মালিকরা ঘোষণা দেন আড়তদারদের কাছ থেকে তারা সরকার নির্ধারিত দামেই কাঁচা চামড়া কিনবেন। জানা গেছে, এই ঘোষণার পর এখন আড়তদাররা মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চামড়া কেনার আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এতে দামও কিছুটা মিলছে। গতকাল রাজধানীর পোস্তায় লবণযুক্ত কাঁচা চামড়া বিক্রি হয়েছে ৪০০ থেকে ১২০০ টাকায়।

বিষয়টি নিশ্চিত করে বাণিজ্য সচিব ড. মো. জাফর উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা আড়তদার, ট্যানারি মালিক, শিল্প মন্ত্রণালয় এবং সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে নিয়ে বৈঠক করেছি। এতে আড়তদার ও ট্যানারি মালিক দুই পক্ষই সরকার নির্ধারিত দামে লবণ দেওয়া চামড়া কেনার বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছেন। চামড়ার দাম নিয়ে গত তিন দিনের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে সচিব বলেন, ঈদের পর গত তিন দিন কিছু সমস্যা হয়েছিল। অনেকেই কাঁচা চামড়া লবণ না দিয়ে নিয়ে আসায় দাম পায়নি। সিলেট থেকে কিছু চামড়া নিয়ে আসা হয়েছিল যার পুরোটাই লবণ ছাড়া। ফলে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ফেলে দেওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তবে এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা উল্লেখ করে বাণিজ্য সচিব বলেন, আমরা ২৪ ঘণ্টা মনিটরিংয়ের উদ্যোগ নেওয়ায় এবার কাঁচা চামড়া নষ্ট হওয়ার হার ১ শতাংশেরও কম। অথচ গতবার প্রায় ১০ শতাংশ কোরবানির পশুর চামড়া নষ্ট হয়েছিল। আর নষ্ট কম হওয়ায় এবার লবণযুক্ত চামড়ার ভালো দাম পাওয়া যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। লবণযুক্ত ভালো মানের চামড়ার দাম পাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে আড়তদারদের কাছেও। সারা দেশ থেকে কোরবানির পশুর চামড়া কিনে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা লবণ দিয়ে রাজধানীর পোস্তার আড়তদারদের কাছে নিয়ে আসেন। আড়তদাররা জানান, গত তিন দিনে প্রায় আড়াই লাখ কাঁচা চামড়া কিনেছেন তারা। গতকাল মাঝারি আকারের চামড়া ৪০০ থেকে ১২০০ টাকায় কেনা হয়েছে। এখন এসব চামড়ায় লবণ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। দু-এক দিনের মধ্যে ট্যানারি মালিকদের কাছে তারা এসব চামড়া তুলে দেবেন। ঢাকার পোস্তাভিত্তিক আড়তদার চামড়া ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আফতাব হোসেন বলেন, সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া কেনার আশ্বাস দিয়েছেন ট্যানারি মালিকরা। তারা চামড়া কেনার জন্য আগের প্রাপ্য কিছু টাকাও পরিশোধ করেছেন। ফলে চামড়া নিয়ে গত তিন দিনে কিছু সমস্যা হলেও এই ঘোষণার পর লবণজাত চামড়ার সঠিক মূল্য পাওয়া যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন এই আড়তদার ব্যবসায়ী। 

রপ্তানির ঘোষণা কেন কাজে লাগেনি : বাংলাদেশ ট্যানারি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, কাঁচা চামড়া ও ওয়েট ব্লু রপ্তানি হয় মূলত চীন, কোরিয়া, জাপানের মতো দেশগুলোতে। তবে করোনার কারণে চীনে কাঁচা চামড়ার চাহিদা কমেছে। এ ছাড়া তারা বিনা শুল্কে বাংলাদেশ থেকে চামড়া নেওয়ার সুযোগ দিলেও যে হিডেন চার্জ আছে সেটি প্রায় ২৫ শতাংশ। ফলে এত বেশি ট্যাক্স দিয়ে এখন আর কাঁচা চামড়া রপ্তানি করা যায় না।

বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আফতাব হোসেন অবশ্য বলছেন, বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা জানেই না, কোথায় কীভাবে কাঁচা চামড়া রপ্তানি করতে হয়। তিনি বলেন, ১৯৬২ সালের পর থেকেই কাঁচা চামড়া এবং ১৯৯০ সালের পর থেকে ওয়েট ব্লু রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। ফলে দীর্ঘ সময় কাঁচা চামড়া রপ্তানি বন্ধ থাকার পর হঠাৎ করে কেস টু কেস ভিত্তিতে কাঁচা চামড়া রপ্তানির ঘোষণা খুব একটা কাজে আসেনি। এ ছাড়া কারা ক্রেতা, কোন দেশ নেয়- সে সম্পর্কেও দেশের ব্যবসায়ীরা খুব একটা ওয়াকিবহাল নয় বলে জানান তিনি।

কাটেনি টাকার সমস্যা : চামড়া কেনায় মূল্য বিপর্যয়ের আরেকটি বড় কারণ মূলধন সমস্যা। আড়তদারদের কাছ থেকে চামড়া নিয়ে বছরের পর বছর ধরে ট্যানারি মালিকরা অর্থ পরিশোধ করছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। আবার হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্পগুলো সরিয়ে নেওয়ার পর গত তিন বছরে প্রায় শতাধিক ট্যানারি মালিক ব্যবসায় লোকসান দিয়ে ঋণ খেলাপিতে পরিণত হয়েছেন বলেও দাবি করেছেন তারা। রাজধানীর পোস্তার আড়তদার চামড়া ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন বলেন, অনেক ট্যানারি মালিকের কাছে তারা তিন চার বছর আগের চামড়া বিক্রির টাকাও পান। এ অবস্থায় নতুন করে চামড়া কিনে ট্যানারি মালিকদের কাছে সরবরাহের বিষয়ে তাদের উদ্বেগ রয়েছে।

এ বিষয়ে ট্যানারি অ্যাসোসিয়েশনের নেতা শাহীন আহমেদ বলেন, ট্যানারি শিল্পগুলো সাভারে চলে যাওয়ার পর যে ধরনের অর্থ সমস্যায় তারা পড়েছেন, সেই সমস্যা সমাধানে বিশেষ ঋণ উদ্যোগের কথা জানালেও তাদের সেই দাবি পূরণ হয়নি। ঈদের আগে তাদের প্রণোদনা সুবিধায় ঋণ দেওয়ার কথা থাকলেও শর্তের মারপ্যাঁচে সেটিও মেলেনি। তবে নানা ধরনের চেষ্টা ও সরকারি উদ্যোগের পর একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক এবার ১১০ কোটি টাকা এবং অন্য ৩টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক আরও ১২০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এর মধ্যে ঈদের আগে ১৫ শতাংশ ছাড় করেছে। বাকিটাও পর্যায়ক্রমে ছাড় করবে। এসব দিয়েই কোরবানির ঈদের চামড়া কেনা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর